ডঃ নির্মল দাশ
প্রস্তাবনা
সাম্প্রতিক সময়ে ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের জেলা ও সন্নিহিত জেলাগুলিতে নানা ধরনের বিতর্ক উঠে আসছে। মুখের ভাষা নিয়ে প্রতিটি মানুষের আবেগ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যে কোন ভাষারই একটা ইতিহাস ও বিজ্ঞান আছে। আবেগ যখন এই ইতিহাস, ও বিজ্ঞনকে অমান্য করে প্রতিষ্ঠা পেতে চায় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। বিষয়টি নিতান্তই ভাষাবিদদের আলাপচারিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে উদ্বেগের বা শহঙ্কার তেমন কোন কারণ থাকে না। কিন্তু এই আবেগ যখন ভাষা-বিজ্ঞান বা ইতিহাস দ্বারা অনুমোদিত না হয়ে কোন সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষকে বিভ্রান্তি ও সর্বনাশের পথে তাড়িত করবার আয়োজনে উদ্যোগী হয় তখন তার মাত্রাকে লঘু করে দেখা যায় না। আবেগ যে কখনো-সখনো বড়ই স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা নিয়ে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে অশুভ আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলতে পারে তার উদাহরণ তো ইতিহাসে ভূরি ভূরি আছে। আবার এই আবেগই ভাষার ইতিহাস, বিজ্ঞান সর্বোপরি একটা জাতির জন্মগত অধিকারের অনুমোদন নিয়েই মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্ম দিয়েছে এ দৃষ্টান্তও আছে।
বেশ কিছুদিন থেকেই আমাদের জেলা ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিছু মানুষ কখনো রাজবংশী ভাষা, কখনো কামতাপুরী ভাষার নামে স্বতন্ত্র একটি ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর দাবিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। ওঁদের বক্তব্যের মূল বিষয় হলো রাজবংশী বা ‘কামতাপুরী’ বাংলা ভাষা থেকে স্বতন্ত্র একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা এবং এই ভাষাগোষ্ঠী বাঙালি নন, স্বতন্ত্র একটি জাতি। বর্তমান সময়ের রাজবংশী সম্প্রদায় এই স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ ভাষাগোষ্ঠীরই মানুষ। এই সূত্রে এঁরা একটি আলাদা রাজ্যেরও দাবিদার। এইসব অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক দাবির সপক্ষে এঁরা নানা ধরনের তথ্যও হাজির করছেন যা ইতিহাস ও ভাষা-বিজ্ঞানের অনুমোদিত নয়।
দীর্ঘদিন ধরে আমরা নানা ভাষাভাষী ও জাতি-ধর্মের মানুষ এই জেলায় ও সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস করে আসছি। মানুষের অধিকার তথা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা বিকাশে আমরা এই অঞ্চলের সম্প্রদায়-নির্বিশেষে নানা জাতি, ধর্ম ও ভাষার মানুষজন নিতান্ত সাক্ষীই নই, শরিকও বটে। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের এই ঐতিহাসিক বোধকে উপলব্ধির মধ্যে রেখেই আমরা এই জেলায় আমাদের সংগঠন গড়ে তোলার। কাজে ব্রতী হয়েছি। আমাদের লক্ষ্যই হলো আমাদের সংগঠন হয়ে উঠুক এই জেলার সমস্ত জাতি, ধর্ম, ভাষা-নির্বিশেষে মানুষের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যৌথ মঞ্চ। তাই সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে ভাষার প্রসঙ্গে যে কোন ধরনের বিতর্কে আমরা নিস্পৃহ থাকতে পারি না। বিশেষ করে যখন ভাষাকে কেন্দ্র করে আপাত-আবেগের আড়ালে একটি শ্রেণী-কৌশল সক্রিয়। এরা ইতিহাসকে বিকৃত করে, সাধারণ মানুষের না-জানার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, বিভক্ত করে, সর্বোপরি আবেগ-তাড়িত করে চেতনার মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। এমন পরিস্থিতি আমাদের সংগঠন থেকে বাড়তি দায়িত্ব দাবি করবে এটাই স্বাভাবিক।,
পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই আমরা আমাদের সংগঠনের তৃতীয় জেলা সম্মেলনে যা গত ১১-১২ জানুয়ারি ‘৯৭ নাগরাকাটায় অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে জেলার ভাষার বিষয়ে একটি বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করেছিলাম ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল মঞ্চে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনটিকে আমরা জেলার কৃতী পুরুষ, সমাজ-সংস্কৃতির রিশিষ্ট গবেষক ডা: চারুচন্দ্র সান্যালের জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি সংগঠনের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে নিবেদন করি। এই অধিবেশনে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত ভাষাবিদ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: নির্মল দাশ। জেলার ভাষা, বিভাষা, উপভাষার প্রশ্নে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে তারই প্রেক্ষাপটে ড: দাশ একটি মূল্যবান বক্তব্য নিবেদন করেন। পরবর্তী সময়ে জেলা সংগঠনের অনুরোধে তিনি তাঁর ভাষণটি লিখিতভাবে আমাদের কাছে প্রেরণ করেন। আমরা সেই প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োচিত ও জেলা সংগঠনের জরুরি ও আশু দায় হিসাবেই মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করলাম।
আমাদের জেলা সংগঠন ড: নির্মল দাশের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রবল শীতের দুটি রাত আমাদের সঙ্গে পরিজন ও সহযোদ্ধার মত কাটিয়ে গেছেন তিনি। পরবর্তীসময়ে লিখিত প্রবন্ধটি পাঠিয়ে এবং তা সংগঠনের সম্পদ হিসাবে মুদ্রণের অনুমতি দিয়ে সহযোদ্ধার দায়-বোধে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। এই পুস্তিকাটির মুদ্রণ ও বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করেছেন অগ্রজ পরিতোষ দত্ত, তাঁর কাছেও আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
আমরা কারো উপর কোনরকম মতামত চাপিয়ে দিতে চাই না। আমরা চাই খোলা-মেলা আলোচনা। আমরা বিশ্বাস করি যুক্তি কখনোই চাপিয়ে দেবার বিষয় নয়, আপন চৈতন্য দিয়ে তা গ্রহণ করার বিষয়। আসুন সবাই মিলে মত বিনিময় করি। এই আলোচনায় সাক্ষী থাকুক ভাষার ইতিহাস ও বিজ্ঞান।
কল্যাণ দে
সম্পাদক: পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ জলপাইগুড়ি জেলা শাখা
কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলন: ঐতিহাসিক বাস্তবতা
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর তাংশ, যাকে সাধারণভাবে উত্তরবঙ্গ বলা হয় এবং যেখানে পশ্চিমবঙ্গের দাজিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ এই ছয়টি জেলা অবস্থিত, সেখানে নানা ঐতিহাসিক কারণে নানা জনগোষ্ঠী ও নানা ভাষাগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করছে। এই এলাকার রাজারাজড়াদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস থাকলেও সাধারণ মানুষ মোটামুটি শান্তিতেই সহাবস্থান করে এসেছে এবং জীবনের সুখদুঃখকে সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যারা এতদিন পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা, প্রীতি ও সৌহার্দোর ভিত্তি অবলম্বন করে সহাবস্থান করে এসেছে আজ তাদের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রশ্নে নানা সন্দেহ, আশঙ্কা ও বিদ্বেষের ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদির নামে নানা অসত্য ও অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশন করে ইস্তাহার ছড়ানো হচ্ছে, খবরের কাগজে চিঠি-লেখালেখি চলছে, কেউ কেউ আবার ছোটো-খাটো বইপত্রও লিখে ফেলছেন। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যাঁরা পুরুষানুক্রমে সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে মাতৃভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে আসছেন, তাঁদের অদ্ভুত, অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে বোঝানো হচ্ছে যে তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা নয় এবং তাঁরাও বাঙালি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত নন। তাঁরা পৃথক জাতি, বাঙালিরা তাঁদের শোষণ করছে বলেই তাঁদের এত দুঃখকষ্ট। তাছাড়া রাজ্য সরকার তাঁদের উপর বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে তাঁদের নিজেদের ভাষার উন্নতি হচ্ছে না। শুধু এতদিনকার বাংলাভাষী মানুষকেই নয়, উত্তর বাংলায় বাংলা ছাড়াও অন্য যেসব ভাষাগোষ্ঠী আছে (যেমন, নেপালী, কুরুখ/ওরাওঁ, সাদরি, সাঁওতালি, রাভা, মেচ, গারো ইত্যাদি) তাদেরও বোঝানো হচ্ছে যে বাঙালি জাতি, বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার আধিপত্যের জন্যই তাদের নিজেদের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটছে না এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নতি ঘটছেনা। এইসব অপপ্রচারের পক্ষে যেসব তথ্য দেওয়া হচ্ছে তা অসত্য ও ভিত্তিহীন হলেও, সাধারণ মানুষের কাছে এইসব ভিত্তিহীন তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। তাই সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ফলে তৈরি হচ্ছে এক বহুবিস্তৃত বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে প্রশ্নোত্তরের আকারে কিছু বিষয় উত্থাপন করা হল, যা মানুষকে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
প্রশ্ন: ১। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির আধিপত্যের জন্যই উত্তরবঙ্গের অন্য জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাধীন বিকাশ হচ্ছে না-একথা কি সত্য?
২ একথা আদৌ সত্য নয়। কারণ (এক) পশ্চিমবঙ্গের অংশ হিসাবে উত্তরবঙ্গের প্রধান ভাষা সাধারণভাবে বাংলা হলেও উত্তরবঙ্গেই এমন ছোটো ছোটো এলাকা আছে যেখানে জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষার স্থান অনেক পেছনে। যেমন ১৯৭১-এর জনগণনার রিপোর্টে দেখা যায় জলপাইগুড়ি জেলার কোনো কোনো এলাকায় জনসংখ্যার বিচারে ভাষাপ্রাধান্যের ক্রম এইরকম:
সদর মহকুমায় এলাকা ভাষা জনসংখ্যা স্থান হিন্দি ২১০৬ প্রথম মেটেলি
কুরুখ ১০৩৭২ দ্বিতীয় নেপালী ৯৫৬৩ তৃতীয়
বাংলা ৮৭৩৯ চতুর্থ হিন্দি ২৩০৯৪ প্রথম নাগরাকাটা কুরুখ ১২৫৩০ দ্বিতীয় নেপালী ১০৪৪৪ তৃতীয় বাংলা ৯১৮১ চতুর্থ
আলিপুর দুয়ার মহকুমায় নেপালী ১৯২৬৫ প্রথম হিন্দি বীরপাড়া ১২৩২১ দ্বিতীয় কুরুখ ১১৫৮১ তৃতীয়বাংলা ৬৭৫৬ চতুর্থ হিন্দি নেপালী ৪০৯৪৩ প্রথম কালচিনি ৩২৬০১ দ্বিতীয় কুরুখ ১৬১২৩ তৃতীয় বাংলা ১৬০৭৬ চতুর্থ
এই হিসাব ২৬ বছর আগেকার। তাই বোঝা যাচ্ছে, এই অবস্থা অনেকদিন ধরেই চলছে। কাজেই একথা পরিষ্কার যে, উত্তরবঙ্গের সর্বত্রই বাংলা ভাষ্যর আধিপত্য আছে এ তথ্য সত্য নয়।
(দুই) আধিপত্যের প্রশ্নে শুধু বাংলা ভাষাকেই দায়ী করা তথ্যসঙ্গত নয়। কারণ ঐ একই জনগণনার হিসাব অনুসারে দেখা যায় উত্তরবঙ্গের ৫৭৮৫২ জন নেপালীভাষীর মধ্যে মাত্র ৭৩৫ জন (পুং ৩৯০ ও স্ত্রী ৩৪৫) লেপচা ভাষা ব্যবহার করেন, অন্যদিকে ১০৯৬০ লেপচা-ভাষীর মধ্যে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ৭৮৯০ (পুং ৪৬৭০ স্ত্রী ৩২২০) জনকে নেপালী ও ২৮০ জনকে (পুং ১৮৫ ও স্ত্রী ৯৫) হিন্দি ভাষা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু উত্তরবঙ্গের ৫৯৭৮৮৩ জন হিন্দিভাষীর মধ্যে মাত্র ৫ জন পুরুষ লেপচা ভাষা ব্যবহার করেন। সুতরাং প্রাধান্য বা আধিপত্যের প্রশ্ন উঠলে শুধু বাংলাকে দায়ী করাই ঠিক হয় না, এব্যাপারে এলাকা-বিশেষে নেপালী ও হিন্দির ভূমিকাও কম নয়।
(তিন) তবে কথা হচ্ছে, যে-এলাকায় পাশাপাশি অনেকগুলি ভাষার চল আছে। সেখানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে কোনো ভাষার প্রাধান্য থাকলে সেই প্রাধান্যকে দমনমূলক আধিপত্য বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে কি না। বস্তুত কোনো ভাষার প্রাধান্যকে তখনই দমনমূলক আধিপত্য বলে ধরে নেওয়া যায় যখন শাসক-শ্রেণী শাসিত শ্রেণীর ভাষার ব্যবহারকে সক্রিয়ভাবে দমন করে। যেমন, পাকিস্তান হবার পর পাকিস্তানি রাষ্ট্রনেতারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের উপর উর্দুভাষার রাজনৈতিক আধিপত্য চাপিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষার স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ ব্যবহারকে দমন করতে চেয়েছিল। এই আধিপত্য অবশ্যই দমনমূলক। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানুষ মাতৃভাষা ছাড়াও আরও কোনো কোনো ভাষার ব্যবহার শিখে নেয়। এখানে দ্বিতীয় বা আরো অন্য ভাষা শেখার ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠীর দমনমূলক বাধ্যতা থাকে না, সামাজিক অর্থনৈতিক কারণে দ্বিতীয় ভাষা বা আরো অন্য ভাষার গুরুত্ব বিবেচনা করে মাতৃভাষা ছাড়াও দ্বিতীয় বা অন্য ভাষা স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া হয়। এই বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য নিজেরই সমৃদ্ধি। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষা বা অন্য ভাষার প্রাধান্য থাকলেও তার অবস্থান দমনমূলক বা আধিপত্যমূলক নয়, বরং দ্বিতীয় বা অন্যান্য ভাষাশিক্ষা সমৃদ্ধি ও আত্মবিকাশের পক্ষে সম্পূর্ণ সহায়ক। কাজেই যে-এলাকায় পাশাপাশি অনেক ভাষার চল আছে, সেখানে জনসংখ্যা ও অন্যান্য দিক দিয়ে এমন কোনো ভাষার প্রাধান্য থাকতে পারে যা বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হলেও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা নয়। এক্ষেত্রে প্রাধান্যবিশিষ্ট ভাষাটি অন্যান্য ভাষার বিকাশে বাধা দিচ্ছে কিনা তা বিচার করতে হলে দেখতে হবে প্রাধান্যবিশিষ্ট ভাষাটির ভূমিকা ঐ এলাকায় দমনমূলক না সহযোগিতামূলক। যদি দমনমূলক হয় তবে তা অবশ্যই অন্য ভাষাগোষ্ঠীর ভাষিক বিকাশের পক্ষে অন্তরায়, কিন্তু যদি তা সহযোগিতামূলক হয়, তবে তা থেকে অন্য ভাষাগোষ্ঠী বিকাশের নানা রসদ সংগ্রহ করে আরো সমৃদ্ধি লাভকরতে পারে। এখানে কোনো ভাষাগোষ্ঠীর বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে ঐ ভাষাগোষ্ঠীর বিকশিত হবার জন্য সমাজের ভেতরকার ইচ্ছাশক্তি ও সন্ধাই বড়ো কথা। সমাজের ভেতরে বিকশিত হবার ইচ্ছা ও সঙ্গল্প সংগঠিত হলে একদিকে যেমন অন্যভাষার দমনমূলক প্রাধান্যকে লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায় (যেমন, পূর্বপাকিস্তানে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল), অন্যদিকে তেমনি প্রাধান্যবিশিষ্ট ভাষার ভেতর থেকে নিজের বিকাশের অনুকূল উপাদানগুলি আত্মস্বাস্থ করে নিজের ভাষ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা যায়। যেমন, মধ্যযুগে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও রাজভাষা ছিল ফারসি। অনেক বাঙালি ব্যবহারিক প্রয়োজনে ফারসি শিখেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার বিকাশে কোনো বাধা হয় নি। তার কারণ বাঙালি তার নিজের সমাজের ভেতরকার প্রেরণায় বাংলায় সাহিত্য সহ অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করেছেন। যাঁরা পেরেছেন তাঁর। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে রসদ সংগ্রহ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন (যেমন, দৌলত কাজি, সৈয়দ আলাওল, ভারতচন্দ্র রায় বা রামপ্রসাদ সেন প্রভৃতি)। আবার বাংলাদেশে ব্রিটিশ শাসন চালু হবার পর ইংরেজরা প্রথমেই এদেশে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চায় নি, তারা চেয়েছিল এদেশের জনগোষ্ঠী মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার মধ্যে আবদ্ধ থাকুক- এজন্য তারা মুসলমানদের জন্য স্থাপন করেছিল মাদ্রাসা ও হিন্দুদের জন্য স্থাপন করেছিল সংস্কৃত কলেজ। তবে রামমোহন রায় প্রমুখ অন্যান্য সমাজনেতাদের চাপে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দেশে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের জন্য সংস্কৃত কলেজের আগেই হিন্দু কলেজ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশে ইংরেজির চল হয়েছিল ইংরেজদের দমনমূলক কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে নয়, বাঙালিদের সামাজিক আগ্রহেই এক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও তা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে কোনো অন্তরায় হয় নি। তার কারণ বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির আধুনিকীকরণ বাঙালি সমাজের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও সঙ্কল্প। বাঙালি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইউরোপের মানবতাবাদী আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। ইংরেজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রে আমরা রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-দীনবন্ধু-বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ- দ্বিজেন্দ্রলাল- বিবেকানন্দ-নেতাজি সুভাষচন্দ্র প্রমুখ দিকপালকে পেয়েছি। আবার কলকাতা যেহেতু দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী ছিল সেই ঐতিহাসিক কারণে বাঙালি সমাজ শিক্ষা-সংস্কৃতি-সামাজিক ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের সুযোগ সবচেয়ে আগে পেয়েছে। এই সুযোগ বাঙালি যেমন নিজে ব্যবহার করেছে তেমনি ওড়িয়া- অসমিয়া- হিন্দি ভাষার মানুষদের মধ্যে যাঁরা বাঙালির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এসেছেন তাঁদের সঙ্গে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফলে ঐসব ভাষা-সাহিত্যেরও আধুনিকীকরণ তথা উন্নয়ন ঘটেছে। পক্ষান্তরে উন্নয়নের প্রশ্নে সমাজের ভেতরে ইচ্ছা ও সংকল্প সংগঠিত না হলে অন্য প্রধান ভাষার আনুকূল্য থাকলেও কোনো ভাষা বা সাহিত্যের উন্নতি হয় না। সেক্ষেত্রে উন্নতি না হওয়ার জন্য প্রধান ভাষাকে দায়ী করার বদলে নিজেদের সামাজিক নেতৃত্বের মিলিত ইচ্ছাশক্তির অভাবকেই মূলত দায়ী করা উচিত। যেমন, বাংলার মতো মৈথিলী ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্যও খুব সমৃদ্ধ, কিন্তু এই ঐতিহ্য সত্ত্বেও আজকের দিনে মৈথিলী ভাষা ও সাহিত্যের যে বিকাশ ও সমৃদ্ধি প্রত্যাশিত ছিল তা হয়ে ওঠে নি। তার কারণ মৈথিলী ভাষা ভারতের যে অংশে প্রচলিত ঐ অংশের মানুষের সামাজিক নেতৃত্বের মধ্যেই মৈথিলী ভাষার উপযুক্ত ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সুবিধাবাদী দ্বিধা আছে। নেতৃত্বের একটি প্রভাবশালী অংশ মনে করে যে মৈথিলীর বদলে হিন্দি ভাষার অনুশীলনেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। তাই মৈথিলীর বিকাশে যে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্তরিকতা অপরিহার্য ছিল তা সংগঠিত হয়ে উঠতে পারে নি, ফলে মৈথিলী ভাষা ও সাহিত্যের অতীত ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হলেও তার বর্তমান বিকাশের মাত্রা আশানুরূপভাবে সমৃদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে, বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় একটি স্বতন্ত্র ভাষা আছে, যা বংশানুক্রমিকভাবে বাংলা-ওড়িয়া-মৈথিলী-অসমিয়ার সহোদরা। এই ভাষার নাম মগহী। এই ভাষাগোষ্ঠীর সামাজিক নেতৃত্ব কখনো মাতৃভাষার প্রাতিষ্ঠানিক সমৃদ্ধি বা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত হয় নি। যাঁরা এই সমাজের নেতৃত্বে আছেন সেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণী জনসংখ্যার নিরিখে সংখ্যালঘু হলেও ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে তাঁরাই নেতৃত্ব দেন, সমাজে এবং দেশের শাসকগোষ্ঠী ও নীতিনির্ধারকদের কাছে তাঁদের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাকি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তারা হতদরিদ্র, নিরক্ষর-খেতমজুর, দিনমজুর বা ঠিকাশ্রমিক ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্বাধিকার বা স্বাধীনতার মর্ম বোঝবার মতো অবস্থা তাদের নেই। ফলে সংখ্যালঘু হলেও মগহী-ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে ঐ সমাজের মধ্যবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণীর মতামতই শেষ কথা। এই সংখ্যালঘু শ্রেণী মাতৃভাষা মণহীর চেয়ে রাষ্ট্রভাষা হিন্দির অনুশীলনকেই সব দিক থেকে সুবিধাজনক মনে করেন। তাই মগহী ভাষার বিকাশের প্রশ্নে কোনো সামাজিক ইচ্ছা ও সংকল্প সংগঠিত হয়ে ওঠেনি। ফলে মগহী ভাষা ও সাহিত্যেরও কোনো সমৃদ্ধি, ঘটে নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভাষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির প্রশ্নে নিজেদের সমাজের ভেতরকার ইচ্ছাশক্তির একাগ্রতাই বড়ো কথা, এখানে প্রতিবেশী কোনো ভাষার প্রাধান্যের প্রশ্নটি নিতান্তই বাইরের। কাজেই উত্তরবঙ্গে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষাগোষ্ঠীর বিকাশের ক্ষেত্রে যদি আশানুরূপ উন্নতি না হয়ে থাকে তবে তার জন্য সরাসরি বাংলা ভাষার প্রাধান্যকে দায়ী না করে নিজেদের সামাজিক নেতৃত্বের মানসিকতাকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। দেখতে হবে সমাজনেতৃত্ব সত্যিই কি তাঁদের মাতৃভাষার বিকাশ চান, না তাঁদের মধ্যে আর-কোনো সুবিধাবাদী মানসিকতা বা তীবস্থান কাজ করছে? বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর সামাজিক নেতৃত্বের মধ্যে নিজ নিজ ভাষার বিকাশের প্রশ্নে ইচ্ছাশক্তি। দ্বিধাহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে রসদ সংগ্রহ করার অসুবিধা নেই। কারণ আগেই বলা হয়েছে, হিন্দি- ওড়িয়া অসমিয়া ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিকীকরণের প্রথম পর্যায়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্য থেকে ঐসব ভাষা-সাহিত্য অনেক রসদ সংগ্রহ করেছে। তাতে বাংলারও সম্পদ কমে যায় নি, ঐসব গ্রহীতা ভাষা-সাহিত্যেরও গৌরবহানি ঘটে নি। সুতরাং আজকের দিনে উত্তরবঙ্গের বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর বিকাশের জন্য দরকার বাংলা ভাষাগোষ্ঠী ও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করা। বাংলা ভাষার পত্র-পত্রিকায় যেমন অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করা দরকার, তেমনি অন্যান্য ভাষার পত্রপত্রিকাতেও বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশিত হওয়া জরুরি। এই কাজটা উত্তরবঙ্গের কোনো কোনো ছোটো কাগজে শুরু হয়েছে, কিন্তু তার পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। তাহলেই উত্তরবাংলার বাংলা ভাষাগোষ্ঠী ও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে সমস্ত ভুলবোঝাবুঝির অবসান হবে। মানুষ বুঝতে পারবে, বাধা যদি কোথাও থাকে তার মূল অন্য ভাষা ও অন্য সংস্কৃতির মধ্যে নেই, আছে অন্য কোথাও এবং সেটা নিজেদের সমাজের অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্যের মধ্যেই। মানুষ আরো বুঝতে পারবে যে, তার নিজের ভাষার যে উন্নতি হচ্ছে না তার প্রধান কারণ, তার নিজের সমাজেরই একটা অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালী অংশ তার মাতৃভাষার উন্নয়নে আগ্রহী নয়।
প্রশ্ন: ২। উত্তরবঙ্গে নেপালী ও অন্যান্য উপজাতিগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া অন্য মানুষরা এতদিন ধরে যে ভাষা ব্যবহার করে আসছেন, ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা তাকে বাংলাভাষার উপভাষা বলেছেন। কিন্তু এখন কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে এটা কোনো উপভাষা নয়, এটা বাংলা থেকে স্বতন্ত্র বাংলারই মতো আর একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাষা। এই নতুন মতের সমর্থনে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। শহীদুল্লাহ্ কি একে স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন?
না। শহীদুল্লাহ সাহেব কোথাও একে স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষা বলে চিহ্নিত করেন নি। তিনি ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা) নামে যে উপভাষার অভিধান সম্পাদনা করেছেন তাতে এই এলাকায় প্রচলিত ভাষারূপকে উপভাষা হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। কোথাও একে স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করেন নি। উৎসাহী ব্যক্তিরা এই অভিধানের প্রথম খণ্ডে মুদ্রিত তাঁর সম্পাদকীয় ভূমিকাটি পড়ে দেখতে পারেন। সুতরাং স্বাধীন ভাষার প্রশ্নে শহীদুল্লাহ-র নামোল্লেখ বিভ্রান্তিকর ও দুরভিসন্ধিমূলক।
প্রশ্নঃ ৩। গ্রিয়ার্সন সাহেব উত্তরবঙ্গের ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলেছেন-এমন কথা অনেকে বলেন। (ক) এ কথা কি ঠিক? (খ) একে কি সত্যি সত্যি রাজবংশী ভাষা বলা যায়?
(ক) না। গ্রিয়ার্সন উত্তরবঙ্গের ভাষাকে রাজবংশী ভাষা বলেন নি। তাঁর Linguistic Survey of India, Volume V, Part 1 (1903) পড়লে দেখা যায় তিনি একে ‘রাজবংশী উপভাষা’ বলেছেন, ভাষা বলেন নি। এই উপভাষার একটি বিকল্প নামও তিনি উল্লেখ করেছেন, তা হল ‘রংপুরী উপভাষা।’
(খ) না। যুক্তির দিক থেকে একে রাজবংশী ভাষা তো নয়ই, ‘রাজবংশী’ উপভাষা বলারও অসুবিধা আছে। কারণ রাজবংশী নামে উত্তরবঙ্গে যেমন একটি কৃষিজীবী সম্প্রদায় আছে, তেমনি রাজবংশী নামে দক্ষিণবঙ্গেও একটি সম্প্রদায় আছ। এঁরা মূলত মৎস্যজীবী। এঁদের ভাষাররূপ রাড়ী-উপভাষা- যা উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা উপভাষা থেকে ভিন্ন। সুতরাং উপভাষার নাম ‘রাজবংশী’ সম্প্রদায়ের নামে চিহিত করলে, তাতে অন্তর্ভুক্ত হায়ে পড়ে এমন একটি উপভাষা যা এই সম্প্রদায়ের নামধারী একটি অংশ ব্যবহার করেন না। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁরা সবাই রাজবংশী নন, তাঁদের মধ্যে বর্ণহিন্দু, মুসলমান, এমনকি সমতলবাসী উপজাতি গোষ্ঠী (মেচ, রাভা)-র মানুষও আছেন। সুতরাং ‘রাজবংশী’ সম্প্রদায়ের নামে উপভাষার নামকরণ করলে এই উপভাষা-ব্যবহারকারীদের অ-রাজবংশী অংশ বাদ পড়ে যায়। তাই কারা ব্যবহার করে তার নিরিখে এই উপভাষার নামকরণ করতে গেলে ‘রাজবংশী’ নামটি প্রয়োগ করা যুক্তিসংগত হয় না।
দ্বিতীয়ত, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায় উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলার মুখ্য ব্যবহারকারী। এই আঞ্চলিক বাংলায় রাজবংশী ও অ-রাজবংশী সমস্ত গোষ্ঠীরই ভাষিক বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে বর্তমান। তবু তারই মধ্যে যদি কোনো অংশে রাজবংশী সমাজের ভাষা-বৈশিষ্ট্য (মূলত উচ্চারণ ও শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে) অন্য-নিরপেক্ষভাবে উপস্থিত থাকে, তবে ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় উপভাষার ঐ অংশকে উপভাষা না বলে উপভাষার উপবিভাগ হিসাবে বিভাষা (Sub-dialect) বলাই সংগত। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা তথা উপভাষার কোনো অংশে যদি রাজবংশী সমাজের নিজস্ব ভাষা-বৈশিষ্ট্য নিচ্ছিদ্রভাবে উপস্থিত থাকে, তবে উপভাষার ঐ অংশের নাম দিতে হবে রাজবংশী বিভাষা, যা সামগ্রিকভাবে ঐ উপভাষারই একটি অঙ্গ বা অংশ। সুতরাং রাজবংশী শুধু বিভাষারই নাম হতে পারে, ভাষার তো নয়-ই, উপভাষারও নয়।
প্রশ্ন: ৪। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের শ্রদ্ধেয় নেতা ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা উত্তরবঙ্গের ভাষারূপকে কামতাবিহারী ভাষা নামে চিহ্নিত করেছিলেন-(ক) একথা কি ঠিক? (খ) ভাষা বলতে কি তিনি বাংলা থেকে ভিন্ন কোনো স্বতন্ত্র ভাষাকে বুঝিয়েছেন? (গ) তিনি কি বাংলা ভাষাকে রাজবংশী সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে অন্তরায় মনে করে রাজবংশী সমাজকে বাংলা ভাষার অনুশীলনে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন?
(ক) হ্যাঁ। একথা ঠিক। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা উত্তরবঙ্গের ভাষারূপকে কামতাবিহারী ভাষা নামে অভিহিত করেছিলেন, তবে সেই সঙ্গে একটি বিকল্প নামেরও উল্লেখ করেছিলেন-কুচবিহারী ভাষা (দ্রষ্টব্য, রঙ্গপুর শাখা সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩১৪ সন, ৩য় সংখ্যা, পৃ: ১২৯)।
(খ) না। কামতাবিহারী ভাষা বলতে তিনি বাংলা থেকে পৃথক কোনো স্বতন্ত্র ভাষার কথা বলেন নি। ‘কামতাবিহারী’-র সঙ্গে বিকল্পে ‘কুচবিহারী’ শব্দটির উল্লেখে বোঝা যায় ভাষা-রূপের নামকরণে তিনি তার ভাষাতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের চেয়ে তার স্থানগত বা আঞ্চলিক চৌহদ্দিকেই বিশেষভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘ভাষা’ শব্দটির মাধ্যমে যখন সমাজ-বিশেষের ভাববিনিময়ের সাধারণ বাচনিকমাধ্যমকে বোঝানো হয় তখন তা সাধারণভাবে ভাবপ্রকাশক যে-কোনো ভাষারূপকেই বোঝায়, এবং তাতে ঐ ভাষার আঞ্চলিক ভাষারূপ বা উপভাষাকেও বোঝায়। কিন্তু যখন বৈজ্ঞানিকভাবে কোনো ভাষারূপকে সুনির্দিষ্ট করা হয় তখন তার জন্য নানা ভাষা-বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়-যেমন ভাষা (পূর্ণাঙ্গ ভাষা), উপভাষা (ভাষার আঞ্চলিক রূপ), বিভাষা (উপভাষার অভ্যন্তরীণ ভাগ), নিভাষা (ব্যক্তিবিশেষের ভাষারীতি) ইত্যাদি। ঠাকুর পঞ্চাননের ভাষাসংক্রান্ত সমস্ত রচনা পড়লেই বোঝা যায় তিনি ‘ভাষা’ শব্দটি সাধারণ ও শিথিল অর্থেই ব্যবহার করেছেন, ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করেন নি। কাজেই কামতাবিহারী (বা কুচবিহারী) ভাষা বলতে তিনি প্রাচীন কামতাপুর রাজ্য বা তার আধুনিক রূপান্তর কুচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত এলাকার আঞ্চলিক ভাষারূপ বা উপভাষাকেই বুঝিয়েছেন (পুনশ্চ দ্রষ্টব্য: রঙ্গপুর শাখা সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, সন ১৩১৪, ২য় সংখ্যা, পৃ ৮৫)।
(গ) না। তিনি বাংলা ভাষাকে কখনোই রাজবংশী সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে অন্তরায় বলে মনে করেন নি, কারণ রাজবংশী সমাজকে তিনি কখনোই বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বাইরে মনে করেন নি। সেইজন। তিনি নিজেও পঞ্চানন সরকার নামে বাংলা ভাষার রঙ্গপুর শাখা সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন ও প্রবন্ধাদি লিখেছেন এবং অন্যদেরও বাংলা ভাষার চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি তাঁর নানা লেখায় এই এলাকার প্রাচীন গৌরবের কথা বলতে গিয়ে প্রাচীনকালে ঐতিহাসিক কারণে বাংলার এই অংশের সঙ্গে বাংলার অন্যান্য এলাকার স্বাতন্ত্র্যের কথা উল্লেখ করলেও বর্তমান কালে সামাজিক অগ্রগতির প্রশ্নে সেই অতীত দিনের ফেলে আসা স্বাতন্ত্রের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখার পরামর্শ কখনো দেন নি। সমাজ-প্রগতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত থাকাই ছিল তাঁর লক্ষ্য এবং অনগ্রসর রাজবংশী সমাজকে সমাজ-প্রগতির মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করার সাধনাই ছিল তাঁর সামাজিক নেতৃত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুতরাং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ও অগ্রগতির প্রশ্নে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আন্দোলন এক হিসাবে শ্রদ্ধেয় পঞ্চানন ঠাকুরের প্রতি অশ্রদ্ধা-জ্ঞাপনেরই সংগঠিত প্রয়াস।
প্রশ্নঃ ৫। সম্প্রতি কিছুদিন হল ইস্তাহার, প্রচারপত্র ও খবরের কাগজে চিঠি লেখালেখির মাধ্যমে কোনো কোনো মহল থেকে সংগঠিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে কামতাপুরী বাংলা ভাষার উপভাষা নয়, প্রাচীন কামতাপুর রাজ্যের রাজভাষা- যা বাংলা থেকে পৃথক। যেমন, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছাত্রসংগঠন ‘অল কামতাপুর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (আকসু) কর্তৃক প্রচারিত একটি ইস্তাহারে দাবি করা হয়েছে: (ক) “কামতাপুরী ভাষা বাংলা আরহ অসমীয়া ভাষার আই (মাও) । কামতাপুরী বাংলা ভাষা আর অসমিয়া ভাষার জননী। এই দাবি কতখানি সত্য? (খ) “ময়নামতী গোপীচাঁদ’ কী বাংলার উপভাষাৎ লেখা? ইটাত হক্ হক্ করিয়া কামতাপুরী ভাষাৎ লেখা”- এই দাবি কতখানি সত্য? (গ) “কোচবিহার রাইজ্যের রাজা মহারাজার শাসনকালে কামতাপুরী ছিলো রাজভাষা বড়য় আদরের। শৈবভূমি রত্নপীঠ কামতাপুর রাইজ্যত কামতাপুরী ভাষাত বই-পুস্তক অনুবাদ লেখা হইসে”- এই দাবি কি যথার্থ? (ঘ) কামতাপুর বা কোচবিহার রাজ্য যতদিন স্বাধীন রাজ্য ছিল ততদিন রাজভাষা কামতাপুরীর স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি “পশ্চিম বাংলার সেলাকার প্রধানমন্ত্রী … বেআইনীভাবে- সংবিধানক অমাইন্য করিয়া ষড়যইন্ত্র করিয়া” কোচবিহার রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্তির কথা ঘোষণা করার পর পশ্চিমবাংলার সরকার কামতাপুরী ভাষার জায়গায় বাংলা ভাষা চালু করে। ফলে কামতাপুরবাসীর নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন- ‘যেই জাতির ভাষা নাই- সেই জাতির কুনহ আশা নাই… কামতাপুরবাসীর আজি ‘জাতীয় সংকট-এই বিবৃতি ও এই আশঙ্কা কতটা সত্য?
(ক) কামতাপুরী বাংলা ও অসমিয়া ভাষার জননী এই দাবি সম্পূর্ণ অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক। কারণ, জন বিস্, হর্নলে, গ্রিয়ার্সন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার। সেন প্রমুখ ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে দশম শতাব্দীর দিকে মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, মৈথিলী, মগহী এবং অসমিয়া ভাষার বিকাশ ঘটেছে। এই সঙ্গে কামতাপুরী নামে কোনো ভাষার কথা পণ্ডিতেরা বলেন নি বা বলেন না।
(খ) ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গান নাথধর্মের সাহিত্য। প্রায় হাজার বছর আগে উত্তরবঙ্গে ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে এই ধর্মের প্রচলন ছিল। এই সূত্রে এই এলাকায় ময়নামতী গোপীচন্দ্রের গান দীর্ঘদিন ধরে লোকের মুখে মুখে চলে এসেছে, কিন্তু এগুলি কখনো লিখিত হয় নি। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিয়ার্সন সর্বপ্রথম এই গান রংপুরের লোকজনের মুখ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন, পরে আরো কেউ কেউ এই মৌখিক সাহিত্য সোকমুখ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন। নাথ সাহিত্যের এই প্রকাশিত লিখিত সংস্করণে গানের যে-ভাষারূপ পাওয়া যায় তা সংগ্রহকালের সমসাময়িক, অর্থাৎ কোনোভাবেই তা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের আগেকার নয়। কালেই গানগুলির চল বহুদিন ধরে থাকলেও তার যে লিখিত ও মুদ্রিত রূপ বর্তমানে পাওয়া যায় তার ভাষাকে প্রাচীনতার গৌরব দেওয়া ইতিহাসম্মত নয়।
(গ) যদিও কামতাপুর রাজের প্রথম প্রতিষ্ঠা কবে এবং কার দ্বারা হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে, তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য যদি বিশ্বসিংহ -নরনারায়ণ-চিলা রায়ের কামতাপুরকেই কোচবিহার রাজ্য বলে ধরে নেওয়া যায় তবে কোচবিহারের রাজভাষাকে কামতাপুরী বলতে কোনো অসুবিধা নেই, এবং একথাও সত্য যে ষোড়শ শতকের নরনারায়ণ থেকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে এই ভাষায় নিজেরা সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং অন্যদেরও এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যে রাজভাষায় “অনুবাদ বই পুস্তক লেখা হইসে” এ দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্র নিয়ে। কামতাপুরে প্রচলিত এই সাধারণ অর্থে একে কামতাপুরী বলা গেলেও ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের দিক থেকে এটি কি নির্দিষ্টভাবে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা, না একে বাংলা ভাষা বলে সনাক্ত করা সঙ্গত? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে যোড়শ শতক থেকে একাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজপরিবার ও রাজকীয় আনুকুলা-প্রাপ্ত কবিদের রচনার ভাষার একটা কালানুক্রমিক নমুনা-সমীক্ষা করা দরকার। যেমন:
। নমুনা: এক।
অহোম-রাজ চুকাফাকে লেখা কামতাপুরের মহারাজা। নরনারায়ণের পত্র (১৫৫৫ খ্রি:):
লেখ নং কার্যাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরস্তারে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বদ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এ গোট কর্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম সতানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেতু ও ধুমাসদ্দার উদ্দণ্ড চাউনিয়া, শ্যামরাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২ ধনু ১ চেঙ্গা মৎস্য ১ জোর বালিচ ১ জকাই ১ সারি ৫ খান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুজি কহি পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১ ছিট ৫ ঘাগরি ১০ কৃষ্ণচামর ২০ শুরুচামর ১০। ইতি শক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।
। নমুনা: দুই।
পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশের মার্কণ্ডেয় পুরাণের অনুবাদ (১৬শ শতক):
পুরাণাদি শাস্ত্রে জেহি রহস্য আছয়। পণ্ডিতে বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।
১১ কোচবিহারের রাজভাষাকে কামতাপুরী বলতে কোনো অসুবিধা নেই, এবং একথাও।
সত্য যে ষোড়শ শতকের নরনারায়ণ থেকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে এই ভাষায় নিজেরা সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং অন্যদেরও এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যে রাজভাষায় “অনুবাদ বই পুস্তক লেখা হইসে” এ দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্র নিয়ে। কামতাপুরে প্রচলিত এই সাধারণ অর্থে একে কামতাপুরী বলা গেলেও ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের দিক থেকে এটি কি নির্দিষ্টভাবে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা, না একে বাংলা ভাষা বলে সনাক্ত করা সঙ্গত? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে যোড়শ শতক থেকে একাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজপরিবার ও রাজকীয় আনুকুলা-প্রাপ্ত কবিদের রচনার ভাষার একটা কালানুক্রমিক নমুনা-সমীক্ষা করা দরকার। যেমন:
। নমুনা: এক।
অহোম-রাজ চুকাফাকে লেখা কামতাপুরের মহারাজা। নরনারায়ণের পত্র (১৫৫৫ খ্রি:):
লেখ নং কার্যাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরস্তারে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বদ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এ গোট কর্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম সতানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেতু ও ধুমাসদ্দার উদ্দণ্ড চাউনিয়া, শ্যামরাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২ ধনু ১ চেঙ্গা মৎস্য ১ জোর বালিচ ১ জকাই ১ সারি ৫ খান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুজি কহি পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১ ছিট ৫ ঘাগরি ১০ কৃষ্ণচামর ২০ শুরুচামর ১০। ইতি শক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।
। নমুনা: দুই।
পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশের মার্কণ্ডেয় পুরাণের অনুবাদ (১৬শ শতক):
পুরাণাদি শাস্ত্রে জেহি রহস্য আছয়। পণ্ডিতে বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।
এ কারণে শ্লোক ভাঙ্গি সবে বুঝিবার।
কামতাপুর বা কোচবিহার রাজ্য যতদিন স্বাধীন রাজ্য ছিল ততদিন রাজভাষা কামতাপুরীর স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি “পশ্চিম বাংলার সেলাকার প্রধানমন্ত্রী … বেআইনীভাবে- সংবিধানক অমাইন্য করিয়া ষড়যইন্ত্র করিয়া” কোচবিহার রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্তির কথা ঘোষণা করার পর পশ্চিমবাংলার সরকার কামতাপুরী ভাষার জায়গায় বাংলা ভাষা চালু করে। ফলে কামতাপুরবাসীর নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন- ‘যেই জাতির ভাষা নাই- সেই জাতির কুনহ আশা নাই… কামতাপুরবাসীর আজি ‘জাতীয় সংকট-এই বিবৃতি ও এই আশঙ্কা কতটা সত্য?
(ক) কামতাপুরী বাংলা ও অসমিয়া ভাষার জননী এই দাবি সম্পূর্ণ অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক। কারণ, জন বিস্, হর্নলে, গ্রিয়ার্সন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার। সেন প্রমুখ ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে দশম শতাব্দীর দিকে মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, মৈথিলী, মগহী এবং অসমিয়া ভাষার বিকাশ ঘটেছে। এই সঙ্গে কামতাপুরী নামে কোনো ভাষার কথা পণ্ডিতেরা বলেন নি বা বলেন না।
(খ) ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গান নাথধর্মের সাহিত্য। প্রায় হাজার বছর আগে উত্তরবঙ্গে ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে এই ধর্মের প্রচলন ছিল। এই সূত্রে এই এলাকায় ময়নামতী গোপীচন্দ্রের গান দীর্ঘদিন ধরে লোকের মুখে মুখে চলে এসেছে, কিন্তু এগুলি কখনো লিখিত হয় নি। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রিয়ার্সন সর্বপ্রথম এই গান রংপুরের লোকজনের মুখ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন, পরে আরো কেউ কেউ এই মৌখিক সাহিত্য সোকমুখ থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন। নাথ সাহিত্যের এই প্রকাশিত লিখিত সংস্করণে গানের যে-ভাষারূপ পাওয়া যায় তা সংগ্রহকালের সমসাময়িক, অর্থাৎ কোনোভাবেই তা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের আগেকার নয়। কালেই গানগুলির চল বহুদিন ধরে থাকলেও তার যে লিখিত ও মুদ্রিত রূপ বর্তমানে পাওয়া যায় তার ভাষাকে প্রাচীনতার গৌরব দেওয়া ইতিহাসম্মত নয়।
(গ) যদিও কামতাপুর রাজের প্রথম প্রতিষ্ঠা কবে এবং কার দ্বারা হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে, তবুও আলোচনার সুবিধার জন্য যদি বিশ্বসিংহ -নরনারায়ণ-চিলা রায়ের কামতাপুরকেই কোচবিহার রাজ্য বলে ধরে নেওয়া যায় তবে কোচবিহারের রাজভাষাকে কামতাপুরী বলতে কোনো অসুবিধা নেই, এবং একথাও সত্য যে ষোড়শ শতকের নরনারায়ণ থেকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে এই ভাষায় নিজেরা সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং অন্যদেরও এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যে রাজভাষায় “অনুবাদ বই পুস্তক লেখা হইসে” এ দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্র নিয়ে। কামতাপুরে প্রচলিত এই সাধারণ অর্থে একে কামতাপুরী বলা গেলেও ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের দিক থেকে এটি কি নির্দিষ্টভাবে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা, না একে বাংলা ভাষা বলে সনাক্ত করা সঙ্গত? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে যোড়শ শতক থেকে একাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজপরিবার ও রাজকীয় আনুকুলা-প্রাপ্ত কবিদের রচনার ভাষার একটা কালানুক্রমিক নমুনা-সমীক্ষা করা দরকার। যেমন:
। নমুনা: এক।
অহোম-রাজ চুকাফাকে লেখা কামতাপুরের মহারাজা। নরনারায়ণের পত্র (১৫৫৫ খ্রি:):
লেখ নং কার্যাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরস্তারে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বদ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এ গোট কর্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম সতানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেতু ও ধুমাসদ্দার উদ্দণ্ড চাউনিয়া, শ্যামরাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২ ধনু ১ চেঙ্গা মৎস্য ১ জোর বালিচ ১ জকাই ১ সারি ৫ খান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুজি কহি পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১ ছিট ৫ ঘাগরি ১০ কৃষ্ণচামর ২০ শুরুচামর ১০। ইতি শক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।
। নমুনা: দুই।
পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশের মার্কণ্ডেয় পুরাণের অনুবাদ (১৬শ শতক):
পুরাণাদি শাস্ত্রে জেহি রহস্য আছয়। পণ্ডিতে বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।
১১ কোচবিহারের রাজভাষাকে কামতাপুরী বলতে কোনো অসুবিধা নেই, এবং একথাও।
সত্য যে ষোড়শ শতকের নরনারায়ণ থেকে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে এই ভাষায় নিজেরা সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং অন্যদেরও এই ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যে রাজভাষায় “অনুবাদ বই পুস্তক লেখা হইসে” এ দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই রাজভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্র নিয়ে। কামতাপুরে প্রচলিত এই সাধারণ অর্থে একে কামতাপুরী বলা গেলেও ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রের দিক থেকে এটি কি নির্দিষ্টভাবে কোনো স্বতন্ত্র ভাষা, না একে বাংলা ভাষা বলে সনাক্ত করা সঙ্গত? এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে যোড়শ শতক থেকে একাল পর্যন্ত কোচবিহারের রাজপরিবার ও রাজকীয় আনুকুলা-প্রাপ্ত কবিদের রচনার ভাষার একটা কালানুক্রমিক নমুনা-সমীক্ষা করা দরকার। যেমন:
। নমুনা: এক।
অহোম-রাজ চুকাফাকে লেখা কামতাপুরের মহারাজা। নরনারায়ণের পত্র (১৫৫৫ খ্রি:):
লেখ নং কার্যাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরস্তারে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বদ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি। তোমারো এ গোট কর্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম সতানন্দ কর্মী রামেশ্বর শর্মা কালকেতু ও ধুমাসদ্দার উদ্দণ্ড চাউনিয়া, শ্যামরাই ইমরাক পাঠাইতেছি তামরার মুখে সকল সমাচার বুঝিয়া চিতাপ বিদায় দিবা অপর উকীল সঙ্গে ঘুড়ি ২ ধনু ১ চেঙ্গা মৎস্য ১ জোর বালিচ ১ জকাই ১ সারি ৫ খান এই সকল দিয়া গইছে। আরু সমাচার বুজি কহি পাঠাইবেক। তোমার অর্থে সন্দেশ গোমচেং ১ ছিট ৫ ঘাগরি ১০ কৃষ্ণচামর ২০ শুরুচামর ১০। ইতি শক ১৪৭৭ মাস আষাঢ়।
। নমুনা: দুই।
পীতাম্বর সিদ্ধান্তবাগীশের মার্কণ্ডেয় পুরাণের অনুবাদ (১৬শ শতক):
পুরাণাদি শাস্ত্রে জেহি রহস্য আছয়। পণ্ডিতে বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।
এ কারণে শ্লোক ভাঙ্গি সবে বুঝিবার।
তিনদিনিয়া বাসিয়া ডোগা ভাল করিয়া ধো।।
ডোগা ধুলু ভাল করিলু তুই সে প্রাণের নাথ।
চট্ট করিয়া চড়েয়া সে তুই দুইটা মানুষির ভাত।।
ভাত আন্দিলু ভাল করিলু তুই সে প্রাণের পতি। বিছানা খান পাতেক এলা ছাওয়া ধরিয়া শুতি।।
১ নংনমুনাটি কামতাপুরী ছাত্রসংগঠন ‘আকসু’ প্রচারিত ইস্তাহারের একটি অংশ।
তাই ইস্তাহারের প্রচারকরা নিশ্চয়ই দাবি করবেন, এই ইস্তাহারটি বাংলায় লেখা নয়, বাংলা থেকে পৃথক ‘কামতাপুরী’ ভাষায় লেখা, কারণ বাংলার সঙ্গে এর অনেক জায়গাতে মিল নেই- যেমন, উদ্ধৃত অংশের সর্বনাম (যাওঁ, তাএও, হামারগুলার, হামেরা ইত্যাদি) শব্দররূপ (রাস্তাত, উড়িষ্যাৎ, অভিশাপক ইত্যাদি), ধাতুরূপ (বাঁচিয়া, হঞা, ঘুরি, সাজিয়া, কহিলে, খাইসে, হইসে, আগেয়া, করিবার হোবে ইত্যাদি) শব্দভাণ্ডার (ভিখ, খেদান, অশুরবাদ, ঢোলডাং ইত্যাদি) লক্ষ্য করলে দেখা যায় লেখাপড়ার জন্য যে বাংলা অর্থাৎ লেখ্য বাংলা ব্যবহার করা হয় তার সঙ্গে এর মিল নেই। ২নং নমুনাটি উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় চটকা গান। এই গানও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সর্বনাম (মুই, তুই), শব্দরূপ (মাথাৎ, কোনাৎ), ধাতুরূপ (না পাং, বয়া, আয়নু, বানেক, বানিলু, করিলু, ধুলু, চড়েয়া, আন্দিলু, শুতি), শব্দভাণ্ডার (অভি, বারা, নাঙ্গল, তিনদিনিয়া, বাসিয়া, ডোগা, মানি, এলা, হাওয়া)-এইসব দিক দিয়ে লেখ্য বাংলার সঙ্গে এই গানের ভাষারূপের সাক্ষাৎ কোনো মিল নেই। সুতরাং মিল নেই কথাটা প্রাথমিকভাবে সত্যি, কিন্তু চূড়ান্তভাবে সত্যি নয়। কারণ দুটি নমুনাতেই যেসব অমিল-সূচক উপাদান আছে তার মধ্যে কতকগুলি একেবারেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, আর কতকগুলি প্রাচীন বাংলাতেও ছিল কিন্তু এখন আর ব্যবহৃত হয় না- যেমন: ১ নং নমুনার বাঁচিয়া, ঘুরি, সাজিয়া, কহিলে, করিবার ইত্যাদি ক্রিয়াপদ এবং ২ নং নমুনার আসিয়া, তুলিয়া, করিয়া, ধরিয়া ইত্যাদি ক্রিয়াপদ। অনুরূপভাবে ১নং নমুনার কর্মবিভক্তি ‘ক’ (অভিশাপক), অধিকরণ বিভক্তি ‘ত’ (রাস্তাত, উড়িষ্যাৎ, আসামত) প্রাচীন বাংলার চর্যাগানেও দেখা যায়: কর্মে ‘ক-মতিএ ঠাকুরক পরিনিবিতা, অধিকরণে ত: হাঁড়ীত ভাত নাই।
(এবিষয়ে আরও তথ্য জানার জন্য দ্রষ্টব্য: উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক গুরুত্ব: ‘উত্তরবঙ্গের ভায়াপ্রসঙ্গ- নির্মল দাশ, কলকাতা ১৯৯৭।) সুতরাং অমিলের ভিত্তি হচ্ছে আঞ্চলিকতা ও প্রাচীনকে ধরে রাখার প্রবণতা অর্থাৎ রক্ষণশীলতা। আঞ্চলিকতার উপাদানগুলি সামগ্রিক নয়, বিচ্ছিন্ন ও খুবই আংশিক, তাই আঞ্চলিকতার উপাদান উদ্ধৃতাংশের মূল ভাষাকাঠামোকে বাংলা ভাষা থেকে পৃথক করতে পারে নি। অন্যদিকে প্রাচীনতা তথা রক্ষণশীলতার উপাদানগুলিই প্রমাণ করছে যে, উদ্ধৃত রচানগুলির ভাষারূপ বাংলা ভাষারই অঙ্গ। সুতরাং যাকে ‘কামতাপুরী ভাষা’ বলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা আসলে বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক কথ্য রূপ- যার সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে লেখ্য বাংলার প্রাথমিক অমিল থাকলেও চূড়ান্ত কোনো অমিল নেই। সব উপভাষাতেই লেখ্য ভাষার সঙ্গে এই ধরনের প্রাথমিক তামিল বিঘ্নিভাবে দেখা যায়, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, এইসব অমিল চূড়ান্ত নয়। কাজেই সামগ্রিকতার বিচারে ‘মিল নেই’ কথাটা ঠিক নয়।
(খ) আগেই দেখা গিয়েছে যে উত্তরবঙ্গের বাংলা উপভাষার সঙ্গে লেখ। বাংলার যে প্রাথমিক অমিল তার ভিত্তি হচ্ছে আঞ্চলিকতা ও রক্ষণশীলতা। আসলে আঞ্চলিকতাও এক ধরনের রক্ষণশীলতা। উত্তরবঙ্গে যাঁরা বাংলাভাষাকে মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন তাঁদের কারো কারো পূর্বপুরুষ অনেক অনেক দিন আগে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে অন্য জায়গা থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেছেন, এবং কালক্রমে নিজেদের আত্মবিকাশের প্রেরণায় আদি-মাতৃভাষা ত্যাগ করে বাংলাভাষাকে নতুন মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু এই গ্রহণ করার সময় পূর্বপুরুষের ভাষার সব উপাদান ত্যাগ করতে পারেন নি। বিশেষত প্রাচীন উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য ও শব্দভাণ্ডার বাংলা ভাষা ব্যবহার করার সময়েও তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এইসব উপাদান শুধু একটা নির্দিষ্ট এলাকাতেই ঢুকেছে, বাংলা ভাষার অন্যান্য এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে নি, তাই সকলের জন্য ব্যবহার্য যে লেখ্য বাংলা তাতে এগুলি স্থান পায় নি। তাই আপাতদৃষ্টিতে এই উপাদানগুলিকে বাংলা ভাষার অঙ্গ বলে মনে হয় না। অন্যদিকে রক্ষণশীলতা অর্থাৎ বাংলা ভাষার প্রাচীন অধুনালুপ্ত উপাদানগুলিকে টিকিয়ে রাখার যে প্রবণতা তার কারণ হিসাবে বলা যায় যে, বাংলা ভাষার মূল স্রোত যে-আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে ঐতিহাসিক কারণে উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ ও সমাজ সেই গতিশীল পরিস্থিতির অংশীদার হতে পারে নি। উত্তরবঙ্গের সমাজ মূলত কৃষিনির্ভর এবং সেই কারণে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাই বাইরের জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগের প্রয়োজন তেমন দেখা দেয় নি, ফলে 1. যোগাযোগ ব্যবস্থারও তেমন উন্নতি হয় নি। অন্যদিকে বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনা ও কলকারখানা স্থাপন ইত্যাদি সূত্রে দক্ষিণবঙ্গের জীবনযাত্রায় গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রে ভাষার ব্যবহারে প্রাচীন উপাদানগুলি টিকিয়ে রাখার বদলে নতুন নতুন উপাদানকে দ্রুত গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। ফলে পুরনো উচ্চারণভঙ্গী, পুরনো শব্দভাণ্ডার দ্রুত বর্জিত হয়েছে। দক্ষিণ বাংলার ভাষারূপই সাহিত্যচর্চা তথা লেখ্য ভাষা হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই গতিশীল লেখ্য বাংলার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের মন্থর ও রক্ষণশীল বাংলা উপভাষার আপাত-পার্থক্য বড়ো করে দেখা দিয়েছে। তবে এখানে আরো বলা দরকার যে শুধু উত্তরবঙ্গই নয়, বাংলার যেসব এলাকা আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতার কারণে বাংলা ভাষার মূল স্রোতের অগ্রগতির সঙ্গে তাল রাখতে পারে নি. সেই সব এলাকার বাংলা ভাষারূপেও আঞ্চলিকতা ও রক্ষণশীলতার লক্ষণ দেখা যায় (যেমন, মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি এলাকা)। তবে উত্তরবঙ্গে এখন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটছে, ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ফলে এই পার্থক্য শীঘ্রই ঘুচে যাবে। শুধু পুরনো প্রজন্মের কথ্য ভাষার মধ্যেই হয়ত আগামী কিছুদিন এই পার্থক্যের জের চলতে থাকবে, কিন্তু তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথ্য ভাষাতে এই পার্থক্য ক্রমে ক্রমে অনেকটাই লুপ্ত হয়ে যাবে। উপভাষা হিসাবে উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ব্যংলার এটাই স্বাভাবিক পরিণতি এবং এই পরিণতিকে মেনে নেওয়াই হবে উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী সমাজের ঐতিহাসিক দূরদর্শিতা।
(গ) না। আগেই বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ভাষারূপের মধ্যে অমিল থাকলেই তাকে আলাদা ভাষার লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা ঠিক নয়, কারণ অমিলগুলি চূড়ান্ত নয়। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলার সঙ্গে লেখ্য বাংলার কিছু আপাত-অমিল থাকলেও ঐ আঞ্চলিক ভাষারূপকে স্বতন্ত্র ভাষা বলে মনে করা সমীচীন নয়। আপাত-অমিলযুক্ত ঐ আঞ্চলিক ভাষারূপের ভাষাতাত্ত্বিক নাম হচ্ছে উপভাষা। সেই উপভাষার নাম হিসাবে কামরূপী, কামতাপুরী বা কামতাবিহারী যে-কোনো শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু সেই নামকরণ শুধু উপভাষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
প্রশ্নঃ ৭। শ্রীধর্মনারায়ণ বর্মা তাঁর ‘A Step to Kamata Bihari Language’ বইতে কামতাপুরীকে উত্তরবঙ্গের কোচ, রাজবংশী, খেন, ব্রাহ্মণ, মুসলমান ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে এই ভাষা একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাষা। (ক) ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে এই বইয়ের সিদ্ধান্তগুলি কতখানি গ্রহণযোগ্য? (খ) এই বইয়ের উদ্দেশ্য কি-আগেকার ভাষাতাত্ত্বিকদের ভ্রান্ত মতের সংশোধন না অন্য কিছু?
(ক) ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে নানা কারণেই ধর্মনারায়ণবাবুর বইয়ের সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, এই বইতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যা ভাষাবিজ্ঞানীদের দ্বারা গৃহীত সাধারণ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। যেমন, তিনি বলেছেন ওড়িয়া, বাংলা, কামতাপুরী ও অসমিয়া ভাষা মৈথিলী ভাষা থেকে উদ্ভূত। অথচ তাঁর এই অভিনব মতের সমর্থনে তিনি কোনো যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য দেন নি। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে সমস্ত ভাষাবিজ্ঞানীই একমত যে মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা, ওড়িয়া, অসমিয়ার সঙ্গে মৈথিলী ভাষারও উদ্ভব। এক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষাবিজ্ঞানীই কামতাপুরী নামে কোনো ভাষার উল্লেখ করেন নি। দ্বিতীয়ত, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধী সুর শোনা যায়, যেমন, কামতাপুরী ‘ভাষা’র উদ্ভবের পেছনে তিনি কোচ ও রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ ‘ভাষা’র বিকাশ ও উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশ্রণের সদর্থক ভূমিকা স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু কামতাপুরী ‘ভাষা’র আরো অগ্রগতির প্রশ্নে তিনি মিশ্রণকে ঠেকাতে বলেছেন। এই পরস্পরবিরোধিতা তাঁর বক্তব্যকে যুক্তির দিক থেকে সামঞ্জস্যহীন করে তুলেছে।
(খ) এই বইয়ের উদ্দেশ্য কোনো পুরনো ভাষাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের ভুল সংশোধন করা নয়। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য এমন নয় যে, তিনি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘কামরূপী’ নামটির অযৌক্তিকতা প্রমাণ করে তার জায়গায় কামতাবিহারী নামটির ব্যবহার চালু করতে চান। আসলে ‘কামতাবিহারী’ নামটি ব্যবহারের মধ্যেই একটা সূক্ষ্ম কৌশল আছে। এই কৌশলের প্রথম নিদর্শন হল, তিনি কামতাবিহারী নামটি শুধু বইয়ের মলাটেই ব্যবহার করেছেন, কিন্তু বইয়ের ভেতরে সর্বত্র ‘কামতাপুরী’ শব্দটি ব্যবহৃত, কোথাও ‘কামতাবিহারী’ নেই। অর্থাৎ দুটিনামের মধ্যে ‘কামতাবিহারী’ নামটির মর্যাদা শুধু শিরোনামের, লেখকের নিজস্ব মতামতের বিস্তৃত ব্যাখ্যায় তার কোনো গুরুত্ব নেই, নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্ব শুধু ‘কামতাপুরী’ নামটির। এই দ্বিমুখী অবস্থান খুবই কৌশলপূর্ণ। এই কৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে ‘কামতাবিহারী’ নামটি শিরোনামের বৃহৎ হরফে ছাপিয়ে রাজবংশী সমাজকে সন্তুষ্ট রাখা। কারণ রাজবংশী সমাজের একাংশের বহুদিনের ইচ্ছা এই ভাষারূপের নাম হোক রাজবংশী ভাষা। কিন্তু ‘রাজবংশী ভাষা’ নাম হিসাবে ব্যবহার করলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বইটি লেখা সেই উদ্দেশ্যের প্রতি অ-রাজবংশী সমাজের সমর্থন ও সহানুভূতি হারানোর আশঙ্কা। আবার ‘রাজবংশী’র বদলে অন্য একটি নাম ব্যবহার করালে রাজবংশী সমাজের সমর্থন ও সহানুভুতি হারানোর আশঙ্কা। এই উভয়সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক চাতুর্যের সঙ্গে তিনি এমন একটি নাম বেছে নিলেন যে নামটি রাজবংশী সমাজের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার দেওয়া। কিন্তু ধর্মনারায়ণবাবু যদি ঠাকুর পঞ্চাননের প্রতি প্রকৃতই শ্রদ্ধাশীল হতেন তবে শুধু মলাটের উপর ‘কামতাবিহারী’ নামটি ব্যবহার করতেন না, বইয়ের সর্বত্র বিকল্পাহীনভাবে শুধু ‘কামতাবিহারী’ নামটিই ব্যবহার করতেন। আসলে বইটির লক্ষ্য জ্ঞানচর্চা নয়, কূটনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি। তাঁর এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে না বললেও বইয়ের ভূমিকায় তিনি কামতাপুরীকে রক্ষা করার জন্য সমস্ত রকম মিশ্রণ থেকে (অর্থাৎ বাংলা ভাষার পরিমণ্ডল থেকে) এই ভাষাকে বিচ্ছিন্ন রাখার আহ্বান জানিয়েছেন (পৃ ৫)। এই আহ্বান আকসু-প্রচারিত ইস্তাহারে উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার আহ্বানের সঙ্গে এক সুরে বাঁধা। তফাত হচ্ছে ‘আকসু’র আহ্বান ‘ঢোলডাং খুলা হাক- ঢ্যারা পিটিয়ে প্রকাশ্য আহ্বান, আর ধর্মনারায়ণবাবুর আহ্বান-বুদ্ধিজীবীর গোপন হাতছানি। (এখানে মনে রাখতে হবে আকসু-র ইস্তাহারে তাদের তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় ধর্মনারায়ণবাবুর নাম আছে।)
প্রশ্নঃ ৮। কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য কী- ভাষার মুক্তি না অন্য কোনো ষড়যন্ত্র? (খ) এই আন্দোলনের পেছনে কারা আছে?
(ক) কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য ভাষার মুক্তি নয়। কারণ উত্তরবঙ্গের আঞ্চ লিক বাংলার নাম কামরূপী, কামতাপুরী বা কামতাবিহারী যা-ই হোক না কেন, উপভাষা হিসাবে তা বাংলারই অঙ্গ। এই ভাষার স্বাভাবিক বিকাশের প্রশ্নে এই রাজ্যে কোথাও কোনো দমনমূলক পরিস্থিতি নেই। তাই ভাষার মুক্তির প্রশ্ন যেমন অবান্তর, ভাষার মুক্তির প্রশ্নে আন্দোলনও তেমনি অবান্তর। আসলে, ভাষা-আন্দোলন একটি উপলক্ষ্য মাত্র, প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে উত্তরবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাকে ‘গণতান্ত্রিক ভাবে রূপায়িত করা। কিন্তু সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ এই পরিকল্পনায় রাজি হবে না। তাই উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষায় যেসব আপাত-অমিল আছে সেগুলিকে ভিত্তি করে প্রথমে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাষাতাত্ত্বিক ‘থিসিস’ লেখা বা লেখানো হল, তাপর শুরু হল ঐ থিসিসের ভিত্তিতে অসত্য বা অর্ধসত্য নানান প্রচার। উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী সাধারণ মানুষকে বোঝানো হল-‘দ্যাখো, যে-ভাষায় বাংলা বইপত্র, খবরের কাগজ ছাপা হয় তার সঙ্গে তোমাদের মুখের ভাষার কত অমিল। কাজেই তোমাদের ভাষা বাংলা নয়, তোমরাও বাঙালি নও এবং সেই কারণে তোমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গে সুরক্ষিত নয়। তোমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য দরকার পশ্চি মবঙ্গের বাইরে তোমাদের নিজস্ব রাজ্য। সুতরাং কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলন আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছদ্মবেশে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ষড়যন্ত্র। এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র বলে মনে হত না, যদি এর উপরে ভাষামুক্তির ছলনাময় ঘোমটা চাপানো না থাকত।
(খ) এই মেকি আন্দোলনের পেছনে কারা আছে জানতে গেলে প্রথমে আকসুর ইস্তাহারের দিকে নজর দিতে হবে। সেখানে তারা স্পষ্ট স্বরে বলছে যে, ১১ই সেপ্টে স্বর ১৯৪৯ তারিখে কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ স্বাধীন রাজ্য কোচবিহারকে ভারত ইউনিয়নের হাতে তুলে দেন। তারপর ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবার আগে পর্যন্ত তিন মাস উনিশ দিন কোচবিহার রাজ্য কমিশনারের শাসনে ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য ছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি কোচবিহার রাজা পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হওয়ার ফলে স্বাধীন অঙ্গরাজ্য কোচবিহার রাজ্য এখন বেআইনীভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাসনাধীন-এর ফলে ১৯৫০ থাকি ১৯৯৬ এত বছর থাকি হামার তামান গেইসে চুরি’। কোচবিহার / কামতাপুর বাসীর স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য সেই তিনমাস উনিশ দিনের স্বাধীন কোচবিহার রাজ্য পুনরায় স্থাপন করতে হবে- ‘নাইজ্য অধিকার আদায় করিবার হোবে-পাওনা গণ্ডা বুঝিয়া নিবার হোবে’। কিন্তু স্বাধীন কোচবিহারকে ভারতের পৃথক অঙ্গরাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠার এই দাবি নিতান্ত সাম্প্রতিক কালের নয়। এটা একটা পুরনো দাবির পুনরুত্থাপন মাত্র। এই দাবি তুলেছিল কোচবিহারের ভারতভুক্তির সময়ে কোচবিহার হিতসাধনী সভার সদস্যদের একাংশ, এই হিতসাধনী সভা ছিল ব্রিটিশ ও কোচবিহার রাজশক্তির অনুগত হিন্দু ও মুসলমান জোতদারদের সংগঠন। ভারতভুক্তির প্রশ্নে সভার মুসলমান সদস্যরা চেয়েছিলেন কোচবিহার পাকিস্তানে যাক, আর সভার অনেক অনেক হিন্দু সদস্যই চেয়েছিলেন কোচবিহার অন্যতম অঙ্গরাজ্য হিসাবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হোক। মহারানী ইন্দিরা দেবীও এই মতের সমর্থক ছিলেন। সুতরাং কোচবিহার রাজ্য ভারতের অঙ্গরাজ্য হোক এটা জোতদার ও রাজন্যশক্তির পুরনো ইচ্ছা। এই সমস্ত শক্তি এই অঙ্গরাজ্যের মধ্যে কোচবিহার-সংলগ্ন ডুয়ার্স এলাকাকেও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। এই উপলক্ষে যেসব প্রচারপত্র তখন প্রকাশ করা হয়েছিল তার একটিতে আছে: “আমাদের পশ্চিম দুয়ারবাসী ভাইগণ, সম্প্রতি ইংরেজরাজ ভারতবর্ষে শাসনভার ছাড়িয়া দিয়া যাইতেছেন।এমতাবস্থায় আমাদের বাপপিতামহগণের সুখ শান্তিপূর্ণ পূর্ব কোচবিহার রাজ্য আমাদের এখন বল ও ভরসাস্থল। যাহাতে আমাদের সুখ শান্তি রক্ষা পায় এবং যাহাতে আমাদের পূর্ব সংস্কার ও সভ্যতা বজায় থাকে তজ্জন্য আমরা পুনরায় কোচবিহার রাজ্যভুক্ত হওয়া সঙ্গত মনে করি। আসুন আমরা সকলে মহারাজ সদনে উপস্থিত হইয়া আমাদের আবেদন জ্ঞাপন করি। আশা করি তিনি আমাদের অভিলাষ পূর্ণ করিয়া আমাদের দুয়ার অঞ্চল কোচবিহার রাজ্যে সংযুক্ত করিবার ব্যবস্থা করিবেন। নিবেদন ইতি সন ১৩৫৪ সন, ১২ই শ্রাবণ। নিবেদক- শ্রীবিধুভূষণ কাৰ্য্যী সাং- পরোর পার, শ্রীতারণীকান্ত রায় সাং- রায়চেঙ্গ, শ্রী গোপালচন্দ্র রায় সাং সিলবাড়ী, শ্রী তারকেশ্বর বসুনীয়া সাং ক্ষেতি ফুলবাড়ী, মহম্মদ আবদুদ্ধোবহান সাং-ফালাকাটা” (মধুপর্ণী, কোচবিহার জেলা সংখ্যা, ১৩৯৬-তে প্রকাশিত আনন্দগোপাল ঘোষ ও শেখর সরকারের প্রবন্ধ থেকে পুনরুদ্ধৃত)। কাজেই বোঝা যাচ্ছে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সাম্প্রতিক দাবি হৃহৃতগৌরব জোতদার ও রাজন্যশক্তির একটি পুরনো ইচ্ছাকেই রূপায়িত করার পরিকল্পনা। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ভূমিসংস্কার, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা, সাক্ষরতা কর্মসূচির মত জনমুখী কাজকর্মে সাধারণ মানুষের স্বার্থ যত সমৃদ্ধ হচ্ছে, পুরনো জোতদার ও রাজন্যশক্তির স্বার্থ তত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুতরাং তাদের স্বার্থরক্ষার জন্যই চাই এমন একটি পৃথক রাজ্য যেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিসংস্কার আইন এবং পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাসহ অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির কোনো প্রভাব থাকবে না। অতএব চাই পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গের বিচ্ছিন্নতা। তবে শুধু জোতদার ও রাজন্যশক্তির মতো পুরনো সামন্ত-শক্তিই যে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে আছে তা-ই নয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তিরও কারসাজি আছে- এই আন্তর্জাতিক শক্তি হল আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যার মূলে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ। এইসব দেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ধনী হলেও নিজেদের দেশের মধ্যে তারা নানারকম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। এইসব সংকট থেকে মুক্তি পাবার জন্য তারা বিশ্বায়নের নামে সারা পৃথিবী জুড়ে নিজেদের পণ্যের বাজার আর লগ্নির বাজার খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই বাজার খুঁজতে গিয়ে তারা লক্ষ্য করেছে যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে এশিয়ায় দুটি খুব বড়ো দেশ আছে -একটি চীন, অন্যটি ভারত। নানারকম ঋণচুক্তি ও বাণিজচুক্তি দিয়ে তারা ভারতের বাজারকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাসী চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, কারণ চীন তার নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় অনেকখানি স্বনির্ভরতা অর্জন করায় পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশগুলির বশ্যতামূলক চুক্তির শর্তে তাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। অতএব পুঁজিবাদী দেশগুলির লক্ষ্য হল চীনের স্বনির্ভর কর্মসূচিগুলি যেভাবে হোক দুর্বল করতে হবে আর এরজন্য চাই চীন সীমান্তের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা যার ধাক্কা চীনের ভেতরে গিয়েও লাগে। চীনের দক্ষিণ সীমান্তের একটা অংশ জুড়ে আছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এই কারণে ভারতে উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে এত সন্ত্রাস, রক্তপাত, হানাহানি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা যত ছড়িয়ে পড়বে পুঁজিবাদী দেশগুলির ততই সুবিধা-এই কারণে আসামের পরেই আসাম-সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ তাদের লক্ষ্যস্থল। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে বোঝা যাবে যে সন্ত্রাসবাদী হামলায় তুফানগঞ্জের কয়েকজন নিরীহ কাঠুরিয়ার সাম্প্রতিক হত্যা নিতান্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এটা একটা বড়ো রকমের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অগ্রিম অশনিসংকেত। শুধু চীন-সীমান্তে গোলমাল বাধিয়ে রাখাই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদীদের উদ্দেশ্য নয়, তাদের উদ্দেশ্য পণ্যের বাজার ও লগ্নির বাজারও দখল করা। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে কলকারখানার বিস্তার ঘটে নি, তাই প্রাকৃতিক সম্পদ যা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা যায় তার ভাণ্ডার এখানে প্রায় অক্ষতই আছে, অন্যদিকে দীর্ঘদিন সামন্তপ্রথার অধীনে থাকায় এই এলাকার মেহনতি মানুষ কখনো শ্রেণীস্বার্থে সংগঠিত হয়ে ওঠে নি। ফলে এখানে কাঁচামাল যেমন অঢেল, অসংগঠিত শ্রমশক্তিও তেমন সুলভ। তাই লগ্নির দিক থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে খুবই লোভনীয়। কিন্তু ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রভাবে শ্রমশক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেবে, ফলে লগ্নিকারীর মুনাফার অংশ কমে যাবে। তাই মেহনতি মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করতে হবে। অতীতে এ ব্যাপারে পুঁজিবাদীরা মেহনতি মানুষের ধর্মীয় পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে কৃষক ও শ্রমিক ঐক্য নষ্ট করত। এখন ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সাংগঠনিক প্রভাবে মানুষ এখন অনেক সতর্ক হয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফর্মুলা এখন সবসময় কাজে লাগছে না। তাই প্রয়োগ করা হচ্ছে নতুন নতুন বিভেদমূলক ফর্মুলা-যার ভিত্তি হচ্ছে মেহনতি মানুষের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রশ্নে কিছু আপাত-অমিল। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলনের পেছনে আছে এই নতুন ফর্মুলায় খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষের ঐক্যবোধ ও সংহতিকে নষ্ট করার পুঁজিবাদী চক্রান্ত। আন্তর্জাতিক এই পুঁজিবাদী চক্র সরাসরি আসরে নামছেনা, তারা আসবে নামাচ্ছে দেশীয় পুঁজিপতি, হৃতগৌরব ভূস্বামী শ্রেণী এবং শিক্ষক-অধ্যাপক-ছাত্র-গবেষক-উকিল-ডাক্তারদের মতো সমাজের প্রভাবশীল মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশকে। সুতরাং কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলনের পেছনে আছে তিনটি ওর। সবচেয়ে পেছনের ওরে আছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী চক্র, তারপর আছে দেশীয় পুঁজিপতি ও ভূস্বামী শ্রেণী এবং তারওপর একেবারে সামনের স্তরে আছে বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যাদের কাজই হচ্ছে পুজিবাড়ী স্বার্থে (এবং অবশ্যই পুঁজিবাদীদের কাছ থেকে কিছু বকশিশ পাওয়ার ব্যক্তিগত স্বার্থে) নানারকম বিভ্রান্তিকর তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে মানুষের সুস্থ বিচারবুদ্ধিকে অকেজো করে দেওয়া।
প্রশ্ন: ৯। যদি কামতাপুর রাজ্য গঠিত হয় তবে সাধারণ মানুষ কি সত্যি সত্যি ‘নাইজ্য অধিকার’ আদায় করতে পারবেন?
যদি কামতাপুর রাজ্য গঠনের মতো অঘটন সত্যি সত্যি ঘটে তবে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে হবে বড়ো রকমের দুর্ঘটনা। কারণ এই রাজ্য গঠনের আন্দোলন করা হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে জোতদারদের স্বার্থে এবং পরোক্ষভাবে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থে। তাই এই রাজ্য গঠিত হলে সেখানে জোতদার ও দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের স্বার্থই দেখা হবে। ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে সেখানে লোকদেখানো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়ত সরকার ও মন্ত্রীসভা গঠিত হবে, তবে সেই সরকার ও মন্ত্রীরা হবে এইসব জনবিরোধী শক্তির প্রতিনিধি। ভূমিসংস্কারের ফলে যেসব ভূমিহীন কৃষক কিছু জমি পেয়েছেন তা জোতদারদের স্বার্থে কেড়ে নেওয়া হবে, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যে গ্রামীণ স্তর পর্যন্ত নীতি নির্ধারণ ও শাসন-ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারছেন তা ভেঙে দিয়ে শুধু রাজধানী থেকে শাসন ও নীতি নির্ধারণ করা হবে। শ্রমিক-কৃষক কেউই ‘নাইজ্য অধিকারে’র প্রশ্নে সভা-সমিতি-মিছিল ধর্মঘটের মতো গণ-আন্দোলন করতে পারবেন না (মনে রাখতে হবে, রাজবংশী কৃষকদের সংগঠিত করার অপরাধে কোচবিহারের রাজশক্তি ঠাকুর পঞ্চাননকে কোচবিহার থেকে বহিষ্কার করেছিল এবং বিদেশী ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা ছিল বলে কোচবিহারের রাজশক্তি ঐ রাজ্যে সমস্ত ব্রিটিশ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করেছিল)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কামতাপুরী ভাষা-আন্দোলন উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষকে কোনো মুক্তির সন্ধান দেবে না, বরং মুক্তির মিথ্যা ছলনায় ভুলিয়ে স্থায়ী পরাধীনতার ফাঁদে ফেলে দেবে।
প্রশ্নঃ ১০। এই ষড়যন্ত্রময় সংকটের মুহূর্তে কী কী করণীয়?
এই মুহূর্তের প্রথম কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষকে এই আন্দোলনের স্বরূপ বুঝিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় কাজ। এই এলাকার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার জন্য প্রকৃত দায়ী কারা তা বুঝিয়ে বলতে হবে। বোঝাতে হবে যে একদিকে জোতদার ও রাজারা এতদিন প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কিছুই করে নি, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশী শক্তির চাপে পড়ে যেসব জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে তার ফলে গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে দুর্দশাগ্রস্ত। এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মেকি মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়ে লাভ নেই, যোগ দিতে হবে সেইসব প্রকৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাদের নেতৃত্বে আছে বিভিন্ন পরীক্ষিত গণ-সংগঠন। তৃতীয় কাজ। যারা বিভ্রান্তির মধ্যে দোদুলামান তাদের বুঝিয়ে সঠিক পথে আনা। চতুর্থ কাজ এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা। পঞ্চম কাজ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পরিমাণ ও বৈচিত্র্যবৃদ্ধি ।।
সাম্প্রতিক সময়ে ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের জেলা ও সন্নিহিত জেলাগুলিতে নানা ধরনের বিতর্ক উঠে আসছে। মুখের ভাষা নিয়ে প্রতিটি মানুষের আবেগ থাকবে এটাই স্বাভাবিকী যে কোন ভাষারই একটা ইতিহাস ও বিজ্ঞান আছে। আবেগ যখন এই ইতিহাস ও বিজ্ঞানকে অমান্য করে প্রতিষ্ঠা পেতে চায় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। বিষয়টি নিতান্তই ভাষাবিদদের আলাপচারিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে উদ্বেগের বা শঙ্কার তেমন কোন কারণ থাকে না। কিন্তু এই আবেগ যখন ভাষা-বিজ্ঞান বা ইতিহাস দ্বারা অনুমোদিত না হয়ে কোন সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষকে বিভ্রান্তি ও সর্বনাশের পথে তাড়িত করবার আয়োজনে উদ্যোগী হয় তখন তার মাত্রাকে লঘু করে দেখা যায় না। আবেগ যে কখনো-সখনো বড়ই স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা নিয়ে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে অশুভ আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলতে পারে তার উদাহরণ তো ইতিহাসে ভূরি ভূরি আছে। আবার এই আবেগই ভাষার ইতিহাস, বিজ্ঞান সর্বোপরি একটা জাতির জন্মগত অধিকারের অনুমোদন নিয়েই মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্ম দিয়েছে এ দৃষ্টান্তও আছে।