“আমি ক্লাসে এতো করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম,যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়।তাহারা তা পড়িল,লিখিল,নম্বর পাইল,পাশ করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল করতাল শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।”
আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান মানসিকতার এই তফাৎ এখনো যে ভীষণভাবে প্রবল প্রায় ১০০ বছর আগেই তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখি গিয়েছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। শুধুমাত্র ভারতের আধুনিক রসায়ন চর্চার পথিকৃৎ হয়েই থেমে থাকেননি তিনি, ছিলেন ছাত্রদরদী শিক্ষক , শিল্পদ্যোগী এবং দেশীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা।
প্রফুল্লচন্দ্রর সমকালীন ভারতবর্ষ কিরকম ছিল তা এককথায় বলতে গেলে ডিকেন্সের ভাষায় বলতে হয়
“It was the best of times, it was the worst of times”. ১৮৬১ সালে যশোরের রাড়ুলি গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। প্রফুল্লচন্দ্রর সমসাময়িক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মদন মোহন মালব্য,আশুতোষ মুখার্জী, লালা লাজপত রাই এবং গান্ধীজী, শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কে। সেই সময় আধুনিক চেতনা এবং জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটছে সারা দেশে।
অন্যদিকে ইংরেজ শাসনে শিক্ষা এবং কর্মজগতে ব্যাপক ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হত ভারতীয়দের। শিক্ষা বিভাগে তখন দুটি পর্যায়। Imperial service যা কিনা শ্বেতাঙ্গদের জন্য সুরক্ষিত আর Provincial service যা শিক্ষিত ভারতীয়দের জন্য পড়ে থাকতো। প্রথমটির মাইনে দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ।
প্রফুল্লচন্দ্র গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ নিয়ে এডিনবরা ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সুযোগ পান এবং ডি এস সি ডিগ্রি লাভ করে ভারতে আসেন। মনে রাখতে হবে সেই সময় এই স্কলারশিপ পেতেন হাতে গোনা কয়েকজন ভারতীয়, সেবারে প্রফুল্লচন্দ্রর সাথে পেয়েছিলেন আর একজন ভারতীয়। যোগ্যতম হওয়া সত্ত্বেও প্রফুল্লচন্দ্র Imperial Service এ যোগ দিতে পারেননি। ১৮৮৯ সালে মাত্র ২৫০ টাকা মাইনেতে প্রেসিডেন্সি কলেজে সাময়িক সরকারি অধ্যাপক পদে যোগ দেন তিনি। সেসময় প্রেসিডেন্সি ছিল রসায়ন চর্চার এক গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এমনকি অন্য কলেজ থেকেও ছাত্ররা প্রেসিডেন্সিতে এসে লেকচার শোনার সুযোগ পেতেন। অধ্যাপক আলেকজান্ডার পেডলার হাতে কলমে রসায়নের পরীক্ষা করে দেখাতেন ছাত্রদের, প্রফুল্ল চন্দ্র শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন তাঁকেও। গবেষণার কাজে প্রফুল্লচন্দ্র কে সাহায্য করতেন স্বয়ং জগদীশ চন্দ্র বোস। ১৮৯৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্রর তৎপরতায় এডিনবরার আদলে প্রেসিডেন্সিতে রসায়নের নতুন ল্যাব তৈরি হয়। এর ঠিক দু বছরের মধ্যেই ১৮৯৬ সালে প্রফুল্লচন্দ্র আবিষ্কার করেন মারকিউরাস নাইট্রাইট, নেচার পত্রিকায় তা প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের রসায়নবিদদের মধ্যে প্রফুল্লচন্দ্রর নাম ছড়িয়ে পড়ে। শুধুমাত্র গবেষক হিসেবেই থেমে থাকেননি তিনি , তৈরি করেছেন যশস্বী ছাত্রদের যাঁরা পরবর্তীকালে পৃথিবী জোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন নীলরতন ধর, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জী, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ,জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিত এবং আরো অনেকে, রসায়ন ছাড়া অন্য বিভাগে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন বোস। শান্তিস্বরূপ ভাটনগর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন যদি তখনকার সব ভারতীয় রসায়নবিদদের যদি মতামত নেওয়া হতো যে নিজেদের মৌলিক গবেষণা করে পেপার পাবলিশ করার অনুপ্রেরণা তাঁরা কার কাছে পেয়েছেন তাহলে অধিকাংশই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রর নাম বলতেন। প্রসঙ্গত ভাটনগরের শিক্ষক অতুল চন্দ্র ঘোষের ও মেন্টর ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র। সারা জীবনে তাঁর প্রায় ১২০ টি গবেষণা পত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্রর অমুল্য কীর্তি History of Hindu Chemistry। দুই খন্ডের এই সুবিশাল বইটিতে ভারতের রসায়ন চর্চার সুবিশাল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।
অলস বাঙালী কে চাকরির মোহ ত্যাগ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য ব্যবসা করার কথা সমসময় বলেছেন প্রফুল্লচন্দ্র, তৈরি করেছেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস। উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় প্রযুক্তিতে ওষুধ ও কেমিক্যাল তৈরি করা আর শিক্ষিত যুবকদের চাকরির সুযোগ তৈরি করা। ১৮৯২ সালে যখন এই প্রতিষ্ঠান শুরু হয় প্রফুল্লচন্দ্র তখন প্রেসিডেন্সিতে কর্মরত। প্রতিদিন বিকেলে ক্লাস শেষ হওয়ার পর অফিসে আসতেন তিনি, খতিয়ে দেখতেন কাজকর্মের অগ্রগতি। প্রফুল্লচন্দ্রর ভাষায় কলেজ ল্যাব থেকে ফার্মেসি ল্যাবে তাঁর এই বিচরণ ছিল তাঁর দৈনন্দিন বিনোদন। আপার সার্কুলার রোডে খুব সামান্য পুঁজি নিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যাল শুরু হয়েছিল, ১৯০১ সালে তা লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি তে পরিণত হয় তখনকার আমলে তার পুঁজি ছিল প্রায় ২ লাখ। এরপর ফ্যাক্টরি আউটলেট তৈরি হয় মানিকতলা মেন রোডে । রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যে আমরা যাকে পরশুরাম বলে চিনি একসময় ছিলেন এই ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার।
এবার আসি জাতীয়তাবাদী প্রফুল্লচন্দ্রর কথায়। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যলয়ে থাকাকালীন তিনি প্রতিযোগিতার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখে জমা দেন যার বিষয় ছিল “India before and after the mutiny” . এতে ভারতে ব্রিটিশ রাজের তীব্র সমালোচনা করা ছিল। প্রবন্ধটি এতটাই প্রসংশিত হয় যে অন্য সব লেখাকে টপকে দ্বিতীয় পুরস্কার পান তিনি। আজও এডিনবরা ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে প্রফুল্লচন্দ্রর এই কৃতিত্বের উল্লেখ আছে। তিনি বলেছেন ” Science can wait but Swaraj cannot”.
তিনি অসহযোগ আন্দোলনেও পরোক্ষ ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। সরাসরি যোগাযোগ ছিল গান্ধীজির রাজনৈতিক গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সাথে। গান্ধীজী যখন প্রথম কলকাতায় আসেন তখন তাকে হাওড়া স্টেশন থেকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। গান্ধীজির সাধারণ জীবন যাপন, কৃচ্ছসাধন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তার নিজের জীবনযাত্রাও ছিল অতি সাধারণ। পরনে ধুতি ও সাধারণ কোট পরে সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। অকৃতদার এই মানুষটি জীবনের শেষ কটি বছর কাটিয়েছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের দোতলার একটি ঘরে। নিজের উপার্জনের অধিকাংশই দান করে গিয়েছেন সমাজের জন্য। অনেক গরীব ছাত্রদের পড়াশোনা চলতো তাঁর টাকায়। অবসরের সময় তাঁর সঞ্চিত এক লক্ষ আশি হাজার টাকা দান করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের উন্নতির জন্য। বেঙ্গল কেমিক্যালের লভ্যাংশ থেকে একটি পয়সাও নিতেননা তিনি পুরোটাই কর্মীদের Welfare এর জন্য দান করে দিতেন।
তাঁর ৭০ তম জন্মদিনেবিখ্যাত রসায়নবিদ এফ জি ডোনান বলেছেন “শুধুমাত্র রসায়নবিদ হিসেবে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রকে বিচার করাটা হবে অপরাধ। বাস্তবমুখী চিন্তার মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নতি করাই ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তিনি হলেন ভারতীয় বিজ্ঞানের সেন্ট ফ্রান্সিস। ভবিষ্যত প্রজন্ম এই ত্যাগী মানুষটিকে মনে রাখবে জ্ঞানের অনির্বাণ দীপশিখা জ্বালিয়ে তা জনসমাজে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। “
যদিও বর্তমান প্রজন্ম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রর চিন্তাভাবনা অনুসরণ করেনি। মেধাবী বাঙালী ছেলেমেয়েরা এখন ভালো প্যাকেজের চাকরি খোঁজে। বাঙালি উদ্যোগপতির সংখ্যা হাতেগোনা। আচার্যর নিজের হাতে তৈরি বাঙালী কেমিক্যাল প্রতিযোগিতার বাজারে কোনমতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। প্রফুল্ল চন্দ্রর কথা পড়ানো হয়না কোনো স্কুল বা কলেজের পাঠ্যপুস্তকে।
ভবিষ্যত দ্রষ্টা প্রফুল্ল চন্দ্র বোধহয় এইজন্য নিজেই লিখে গিয়েছিলেন– ” I have no sense of success on any large scale in things achieved..but have the sense of having worked and having found happiness in doing so”.
@সংগূহীত