বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণ ও স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা গরীব ও সাধারণ মানুষকে বিদ্যুতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নয়া কৌশল এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন
এক ইউনিট বিদ্যুৎ ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা দিয়ে কিনতে মনে মনে তৈরী হোন। মাঝরাতে আপনার স্মার্ট মিটারের একাউন্টে ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলে রাত্রে অন্ধকারে থাকতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হোন। সন্ধ্যা- রাত্রিবেলা ঘরে আলো-পাখা চালালে দিনের বেলার চেয়ে বেশী বিদ্যুৎ মাশুল দিতে রাজী হয়ে যান। কৃষিকাজ করলে পাম্পের জলের আশা ছেড়ে দিন। মাসে ২-৩০০০ টাকার বিল না দিতে পারলে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগের যুগে অন্ধকারে ফিরে যান। হ্যারিকেন, তেলের প্রদীপ, লম্ফ বা মোমবাতি জালিয়ে থাকার জন্যে প্রস্তুত হোন।
প্রথমেই বলে রাখি আমরা প্রযুক্তি বিরোধী নই। বিদ্যুৎ প্রতিটি মানুষের অধিকার। বিদ্যুৎ আধুনিক মানব জীবনের অন্যতম চালিকা শক্তি। স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্রয়সাধ্য মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতি – আমরা তারই বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার আগে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পেতেন মুষ্টিমেয় কিছু ধনী মানুষ। পরে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়েনের লক্ষ্যে সার্বজনীন বিদ্যুতের পরিকাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সংবিধানের যৌথ তালিকাভুক্ত করে, বিদ্যুৎকে জনকল্যাণমুখী পরিষেবা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যে জ্যোতি বসুর সরকার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে বিশেষ করে নয়া উদারীকরণের পরে সকল রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকেও খোলা বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুতের মতো পুঁজি নিবিড় শিল্পে যখন কয়েক দশকের পরিকল্পনা মাফিক মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজ দ্রুততার সাথে চলছে, ঠিক সেই সময় ২০০৩ সালে কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত এন ডি এ জোট অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার পুরনো আইন সংশোধণ করে বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ লাগু করে রাষ্ট্রায়ত্ব বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বেসরকারীকরণের ব্যবস্থা পাকা করে দেয়। এই আইনে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোর কাঁধে ঠেলে দেয়। পারস্পরিক ভর্তুকি তুলে দিয়ে কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার ছেঁটে ফেলার চেষ্টা হয়। ২০০৪ সাল থেকে বামপন্থীদের ও সারা দেশের বিদ্যুৎ কর্মী, অফিসার ও ইঞ্জিনীয়ারদের সম্মিলিত ধারাবাহিক লড়াইয়ের ফলে বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্য মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানাতে এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার অভিসন্ধি সফল হয় নি। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০% বেশী বেসরকারী হাতে থাকলেও ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি সরকার বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে বেসরকারী হাতে তুলে ওয়োর আগ্রাসী প্রয়াস চালালেও ভারতের বিদ্যুৎ ফেডারেশনের অদম্য আন্দোলন সংগ্রামের কাছে বারংবার প্রতিহত হয়। সেই জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ঘুরপথে নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু কর্পোরেটদের মুনাফা অর্জনের মৃগয়া ক্ষেত্র করে দিতে বিদ্যুৎ বণ্টন ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের আকর্ষণীয় শব্দবন্ধ দিয়ে “প্রিপেইড স্মার্ট – মিটার” ব্যবস্থা কার্যকর করতে চাইছেন, এই প্রচেষ্টার পক্ষে আমাদের রাজ্যে বর্তমান তৃণমূল সরকারও কাজ করছে।
কেন স্মার্ট মিটার বিরোধিতা করবেন
(১) স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা কার্যকর হলে ব্যপক হারে অ-বৈদ্যুতিকরণ হবে। প্রিপেইড মিটার অগ্রিম টাকা দিয়ে নিতে হবে। টাকা ফুরিয়ে গেলে তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এছাড়াও মিটারের কোনও ত্রুটির জন্য যদি টাকা শেষ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে গ্রাহকের কিছুই করার থাকবে না। যে সব গ্রাহকের কনট্রাকচুয়্যাল লোড কম আছে সেক্ষেত্রে বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়ে গেলে তারা বিপদে পড়বেন। কানেক্টেড লোড ঠিক না করা পর্যন্ত্য মিটার ঘন ঘন বন্ধ হবে।
(২) পারস্পরিক ভর্তুকি ব্যবস্থা উঠে যাবে। কৃষক ও গরীব মানুষ স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার হারাবেন। বাজার নির্ধারিত মূল্যেই সাধারণ মানুষকে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হবে। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে বহুগুণ। ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহকদের ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলা হলেও একইরকমভাবে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি লুপ্ত হয়ে যাওয়া আমাদের স্মৃতি টাটকা।
(৩) এখন পর্যন্ত বিল জমা দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমার পর আরও ১৪ দিন সময় পাওয়া গ্রাহকের আইনী অধিকার। প্রিপেইড স্মার্ট মিটারে সেই ব্যবস্থা আর থাকবে না। গ্রাহক টাকা জমা করলেই তবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে। অগ্রিম টাকা জমা না করলে ঘরে আলো জ্বলবে না। এই প্রক্রিয়া আসলে গ্রাহক ও বণ্টন কোম্পানীর চালু এগ্রিমেন্ট বিরোধী: বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার সময় এগ্রিমেন্টে উল্লেখ আছে যে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরই গ্রাহক বিদ্যুতের দাম মেটাবে। এই এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী আগাম টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য গ্রাহককে বাধ্য করা যায় না। গ্রাহক রাজি না হলে কেউ জোর করে মিটার বদলাতে পারবে না।
প্রিপেইড মিটারে গ্রাহকরা আগাম টাকা জমা করে তবেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে। চালু নিয়মে ডিউ ডেটের পর ১৪ দিন সময় পাওয়া আইনি অধিকার। তা আর থাকবে না। যারা আগাম টাকা ভরতে পারবে না তাদের ঘরে আলো পাখা চলবে না।
(৪) স্মার্ট মিটার বসলে চালু হবে দিনের বিভিন্ন সময়ে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম। সন্ধ্যার পরে বিদ্যুতের চাহিদা বেশী থাকায় তখন বিদ্যুতের দাম দিনের বেলার চাইতে অনেকটাই বেশী হবে। ফলে বহু মধ্যবিত্তের বাড়ীতেই আলো পাখা বন্ধ থাকবে। সারা দিন রাতের বিদ্যুতের দামকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা, সন্ধ্যা ৫টা থেকে রাত ১১টা এবং রাত ১১টা থেকে সকাল ৫টা পর্যন্ত। সন্ধ্যার সময় বিদ্যুতের চাহিদা ও দাম দিনের বেলার চেয়ে অনেকটাই বেশী হবে। সরকার বলছে যখন দাম বেশী, তখন বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে নিলেই হলো। আসল দাম এতটাই বাড়বে যে আপনাকে সন্ধ্যাবেলা লাইট-ফ্যান বন্ধ করে অন্ধকারে থাকতে হবে।
(৫) বিদ্যুৎ কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সর্বোচ্চ দাম ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়েছে। বর্তমান বাজার থেকে বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাকে ২০-৩০-৫০ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। ফলে নতুন প্রকল্প অনুযায়ী বিদ্যুৎ গ্রাহককেও একই দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। স্মার্ট মিটারের ব্যবস্থা একজন গ্রাহককে সরাসরি খোলা বাজারের মুখে ঠেলে দেওয়ার এক টেকনিকাল পদ্ধতি চালু করবে। এছাড়াও বিদ্যুতের চাহিদা ও যোগানের ক্ষেত্রে উপভোক্তাদের এক বিপুল তথ্য ভান্ডার চলে যাবে বেসরকারী মালিকদের হাতে। তাদের ইচ্ছেমতোই বদলে যাবে বিদ্যুতের জোগান ও দাম। সরকারী সংস্থার লাইন, সাবস্টেশন সব ব্যবহার করবে আদানি, টাটা। বিদ্যুৎ বণ্টন পরিকাঠামো বানানো সরকারী সংস্থার হাতে পড়ে থাকবে সবচেয়ে অলাভজনক গ্রামীণ ও কৃষি এলাকা। সরকারী পরিকাঠামো ব্যবহার করে প্রাইভেট কোম্পানী বাজার দখল করবে। এলাকার বাজার দখল হয়ে গেলে বিদ্যুতের দাম চড়া হবে কর্পোরেটের ইচ্ছামত, যেমন হয়েছে জিও নেটওয়ার্ক আসার পর।
(৬) রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাকে বাজার থেকে বিদ্যুৎ কিনে নিজেদের পরিকাঠামোর মাধ্যমে গ্রাহককে পৌঁছে দিতে হবে, অথচ নিজেদের সরবরাহ করা বিদ্যুতের টাকা আদায় করার জন্য রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানীকে বেসরকারী থার্ড পার্টির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।কি
(৭) বেসরকারী বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাগুলি তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী লাভজনক নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করে বিদ্যুৎ বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারবে। ফলে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা আর্থিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়বে, ভেঙে পড়া রাজ্য সরকারী বিদ্যুৎ বন্টন সংস্থাগুলি পুরোপুরি বেসরকারী সংস্থার হাতে চলে যাবে এবং তাদের ভেঙে পড়া পরিকাঠামোর ফলে গ্রামীণ ও প্রান্তিক এলাকায় ব্যাপক অ-বিদ্যুতায়ন ঘটবে।
(৮) এই স্মার্ট মিটারের দাম ৮০০০ টাকা থেকে ১২০০০ টাকা। যা কিস্তিতে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হবে। বর্তমানে মিটারের জন্য ১০ টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। স্মার্ট মিটারের ক্ষেত্রে মাসিক কিস্তি দাড়াবে ১০০ টাকারও বেশী। এই স্মার্ট মিটারের আয়ু ৭ থেকে ৮ বছর মাত্র।
(৯) সব চেয়ে বড় হামলা নামবে কৃষকের ওপর। সেচের পাম্পের লাইন আলাদা করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পে। কার্যতঃ বাজারের দামে কৃষককে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এই দাম কৃষকদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না। ৩.৫০ লক্ষের বেশি যে পাম্পের কানেকশন আমাদের রাজ্যে রয়েছে, তার ওপর নামবে বিপুল বিলের বোঝা। ডাইরেক্ট ট্রান্সফারের নামে তুলে দেওয়া হবে সাবসিডি। বিদ্যুতের অভাবে কৃষকের তিন ফসলা জমি শুকিয়ে যাবে। খাদ্য শস্য সহ সব জিনিসের ওপর পড়বে এর ভয়াবহ প্রভাব।
(১০) সাইবার হামলা হলে সারা দেশে গ্রীড ব্যবস্থা বসে যেতে পারে। যে বিশ্ব ব্যাংকের নির্দেশে এই স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেই বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টেই বলা হয়েছে এই প্রযুক্তি অত্যন্ত বিপজ্জনক। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে।
(১১) এই ব্যবস্থা দেশের এবং দেশের মানুষের সার্বভৌমত্ব ও রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবে।
সরকারী বিদ্যুৎ শিল্প ও তার ব্যবস্থাকে ধ্বংস এবং বিদ্যুতের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে গ্রাহক বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও, শ্রমিক-কর্মচারী বাঁচাও, সরকারী বিদ্যুৎ পর্ষদ বাঁচাও, বেসরকারী বহিরাগত কোম্পানীর হাতে স্মার্ট মিটার ও বিদ্যুৎ বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে সর্বত্র ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। দেশ ও রাজ্য জুড়ে রক্ষা করতে হবে বিদ্যুতের অধিকার।