কাশ্মীরে সর্বদা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পাঞ্জাবী ও বৌদ্ধদের সহাবস্থান দ্বিল এবং যে রাজা ১৯৪৭-এর পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে আপেক্ষিকভাবে মুক্ত ছিল, সেই কাশ্মীর আজ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার শিকার। কাশ্মীরের এই রাজনৈতিক পরিণতির জন্য অনেকটাই দায়ী ভারত সরকার ও কংগ্রেস নীতি। হরি সিং যখন Treaty of Accession সই করেন, তখন তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আশ্বাস দিয়েছিলেন যে কাশ্মীরিয়াতকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। এই সূত্র ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে শেখ আবদুল্লার চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০সং ধারা যোগ করা হয়। এই ধারার মাধ্যমে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু নেহরুর আমলেই সেই আশা অলীক যন্ত্রে পরিণত হয়।
ভারতভুক্তির পরই মহারাজা হরি সিং অম্মু ও কাশ্মীরের জনপ্রিয় ন্যাশন্যাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লার পক্ষে সমস্ত কর্তৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু উৎপাদন কাঠামোর সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ধ্বংস করে নতুন কাশ্মীর গঠনের যে লক্ষা শেখ আবদুল্লা গ্রহণ করেন তা শুধু অপূর্ণই থেকে যায় নি-জন্ম দিয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের। কাশ্মীরে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও জমিজমা, ব্যবসা ও আমলাতন্ত্রে তাদের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। অনাদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় কৃষিকাজ, নৌকাচালনা ইত্যাদি পুরাভস প্রথায় জীবিকা নির্বাহ করত। কিঞ্চ যখন শেখ আবদুল্লা ভূমি সংস্কার ও সরকারী উদ্যোগে ব্যবসা বাণিজ্য চালু করতে সচেষ্ট হলেন, তখন অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুদের সঙ্গে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনগ্রসর মুসলমানদের সংঘাত দেখা দিল।
হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠনগুলি এই নতুন অবস্থাকে ব্যবহার করে ডোগরা বিরোধী’ কমিউনিষ্ট সমর্থক ‘ন্যাশন্যাল কনফারেন্স-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। প্রজা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি প্রাথমিকভাবে গড়ে উঠলেও অনস্য ও হিন্দু মহাসভার ক্রম যোগদানে এই আন্দোলনের সঙ্কা ছিল, “to achieve full integration of Jammu and Kashmir state with the rest of India like other acceding states, and safeguard the legitimate democratic rights of the people of Jammu (le. Hindus)”. এই হিন্দু ভাবাবেগ স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীরী মুসলিম মানসিকতায় ‘একটি হিন্দু ভারতে বসবাসের ভয় সৃষ্টি করে দিয়েছে। দুঃখের কথা নেহরুও শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বায়রশাসনের পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অসমর্থ হলেন ও ক্রমাগত ৩৭০ ধারার অবক্ষয় ঘটালেন। জওহরলালের সৌভাগা যে কাশ্মীর বিষয়ে তাঁর পদক্ষেপ ন্যাশন্যাল কনফারেন্সের মধ্যে থেকেই সমর্থিত হয়। শেখ আবদুল্লার ক্যাবিনেট সহায়ক বক্সী গোলাম মহম্মদের নেতৃত্বে তিনজন মন্ত্রী আবদুল্লাকে অভিযুক্ত করে বলেন তিনি জনগণের আস্তা হারিযেছেন, ‘দতুন দিল্লীর সঙ্গে চুক্তি রূপায়ণে বিলম্বিতকরণের দরুন। আবদুল্লা অবশ্য তা সত্বেও পদত্যাগ করেন নি, ১৯৫৩-র অগস্টে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ক্ষমতালোভী বক্সী গোলাম মহম্মদ জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষমতা দখল করেন। আর এই সমস্ত ঘটে যায় নিঃসন্দেহে নেহরুর অনুমোদনে। এইভাবে জম্মু ও কাশ্মীর বিষয়ে নয়াদিল্লী কর্তৃপক্ষের দৃঢ়রূপে অনধিকার প্রপ্রবেশ ঘটে।
এই সময় থেকে নয়াদিল্লী সরকার ক্রমাগতভাবে কাশ্মীরের দ্বায়ত্তশাসনের আশ্বাস খর্ব করতে থাকে। যেমন, ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির ঘোষণানুযায়ী কাশ্মীর আইনসভার কার্যকলাপ অনেকাংশে সংকুচিত করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯শে মার্চ নেহরু কাশ্মীরের গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৩ সালে সদর-ই-রিয়াসত-এর অফিস এবং কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর পদে পরিণত করা হয়। সেইসঙ্গে ভারতরাষ্ট্রের হিসাব পরীক্ষা, শুল্ক, অর্থ, সুপ্রিমকোর্ট এবং নির্বাচন কমিশনের এলাকা জম্মু ও কাশ্মীর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ও ৩৫৭ ধারার এক্তিয়ার কাশ্মীর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা এবং ভারতীয় লোকসভা কর্তৃক কাশ্মীরে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কাশ্মীরবাসী এতে অপমানিতবোধ করেন এবং ১৯৫৩-র অগস্ট থেকেই কাশ্মীরবাসীর অনেকাংশ ও ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে ভাবাবেগের অবনতি হতে থাকে। শেখ আবদুল্লা সঠিকভাবেই স্মরণ করেন। ১৯৫৩ সাল থেকেই আমি অনুভব করেছিলাম যে কাশ্মীরের জনগণ ভারতীয় নেতৃত্বের প্রতি আর আস্থাভাজন নয়। কাশ্মীরের উপর নয়াদিল্লীর এই কেন্দ্রীয়করণের ধারা ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে, বিশেষত ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের পরে, আরও শক্তিশালী হয়। বাস্তববাদী শেখ আবদুল্লা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সরকারের সঙ্গে এক চুক্তি সই করেন। ফলে দিল্লী এবং শ্রীসগরের মধ্যে কাজের সমন্বয় শেখ আবদুল্লার মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৮২-র সেপ্টেম্বর) বজায় ছিল। কিন্তু শেখ আবদুল্লার উত্তরাধিকারী, তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লা, ক্রমাগত কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান নেওয়ার গোলমাল বাধে। এরই পরিণামে ১৯৮৩ সালের জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনে ন্যাশন্যাল কনফারেন্স ও শ্রীমতী গান্ধীর কংগ্রেস পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। শ্রীমতী গান্ধী ফারুকের দলকে পরাজিত করতে হিন্দু কার্ড’ ব্যবহার করেন। তা সত্ত্বেও ফারুক নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হন। কিন্তু কংগ্রেস চক্রান্ত করে দল ভাঙিয়ে ফারুককে ক্ষমতাচ্যুত করে। জি.এম. শাহ মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু জনগণের। মধ্যে তাঁর বিশেষ প্রভাব ছিল না। এইভাবেই কাশ্মীরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘটে যায় যার ধারা আজও বর্তমান। @সংগৃহীত @freemang2001gmail-com